কলমেঃ সুমন্ত বাগ
প্রতিবাদের ভাষা ও রক মিউজিক
ষাটের দশকের উত্তাল আমেরিকা। পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ভিয়েতনামের যুদ্ধ, কালো মানুষদের অধিকার রক্ষায় বিদ্রোহ, সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির হত্যাকাণ্ড। সবমিলিয়ে ষাটের দশক শুরু হয় এক ভয়াবহ রাজনৈতিক অরাজকতার মধ্যে দিয়ে। দেশের একটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধারণা জন্মায় যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শুধুমাত্র পারিবারিক মূল্যবোধ একমাত্র পথ নয় এই সামাজিক ও বর্ণগত সমস্যাগুলির মোকাবিলায়। তারা প্রতিবাদের নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে। চুল লম্বা করে, উদ্ভট পোশাক পরে এবং গানের লিখে প্রতিবাদ জানানো শুরু করে। ৫০ এর দশক থেকেই আমেরিকায় রক অ্যান্ড রোল মিউজিকের প্রচন্ড জনপ্রিয়তা ছিল। এলভিস প্রেসলি, চাক বেরি, লিটল রিচার্ড, বি বি কিং-দের সুরের মূর্ছনায় দুলে উঠেছিল আমেরিকা তথা গোটা বিশ্ব। সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রীয় লোকসঙ্গীতের শিল্পীরা। এরা সবাই মিলে একসঙ্গে প্রতিবাদের গান লিখতে শুরু করেন। বব ডিলানের গলা থেকে বেরিয়ে আসে “ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড”- এর মত কালজয়ী গান। নবাগত ” বিটলস “- রা পর্যন্ত লিখে ফেলে ” আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইওর হ্যান্ড”। পিট সিগার, জোন বায়েজ, এরিক ক্ল্যাপটনরা গিটার হাতে রাস্তায় নামেন প্রতিবাদী তরুণ প্রজন্মের পাশে হাঁটার জন্য। শিক্ষার মূল্য নেই, বাজারে চাকরি নেই, বেঁচে থাকার কোন লক্ষ্য নেই.. এই অবস্হায় তরুণ প্রজন্মের আসক্তি জন্মায় সেক্স আর মাদকে।
ডোর্সের উত্থান
ষাটের দশকের মাঝামাঝি ভেনিস বিচ ছিল হিপিদের আস্তানা। ৪ কিমি দীর্ঘ বিচজুড়ে চলত মাদকের যথেচ্ছ ব্যবহার। এই মাদকাসক্তদের অনেকেই ছিলেন কবি, উঠতি চিত্র পরিচালক ও গিটারবাদক। এখানে প্রতিদিন মাদক সেবন করতে যেতেন ইউ সি এল এ( ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস) -এর ফিল্ম ইনষ্টিটিউটের দুই ছাত্র জিম মরিসন ও রেমন্ড মাঞ্জারেক। মরিসন ছিলেন শখের কবি আর মাঞ্জারেক ছিলেন দুর্দান্ত পিয়ানো বাদক। একদিন মরিসনের লেখা “মুন লাইট ড্রাইভ” নামের একটি কবিতাকে সুর দেন মাঞ্জারেক। ধ্যানের ক্লাসে মাঞ্জারেকের আরো দুজন বন্ধু ছিলেন। তাঁরা হলেন রবি ক্রিগার ও জন ডেন্সমোর। ক্রিগার দারুণ গিটার বাজাতেন আর ডেন্সমোর ড্রাম। চারজনে একসঙ্গে “মুন লাইট ড্রাইভ” গানটিকে পৃথিবীর আলো দেখান। গানটিতে গলা দিয়েছিলেন মরিসন নিজে। এইভাবে জন্ম হয় ” দ্য ডোরস”- এর। “ডোরস” নামটি জিম মরিসনের দেওয়া। তাঁর প্রিয় বই “দ্য ডোরস অফ পারসেপশন”, অল্ডাস হাক্সলের লেখা থেকে নামটি নেওয়া।
“ডোরস” মূলত সাইকেডেলিক রক, ব্লুজ রক, হার্ড রক জাতীয় গান বাঁধতে শুরু করে। মরিসনের ভরাট গলা, মাঞ্জারেকের অতুলনীয় কিবোর্ড, ক্রিগারের ক্লাসিকাল ব্লুজ আর স্প্যানিশ ফ্ল্যামেঙ্কোর সুর, ডেন্সমোরের বুকে কম্পন ধরানো ড্রামবিটের মাধ্যমে “ডোরস” খুব সহজেই আমেরিকার তরুণ প্রজন্মকে নাড়িয়ে দেয়। আরো একটা জিনিস যেটা “ডোরস”কে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল সেটা হল তাদের লিরিক। কি ছিলনা “ডোরস”-এর গানে!ভালোবাসার কালো দিক, পাগলামির চুড়ান্তপর্যায়, মৃত্যুর সৌন্দর্য, সড়কের রোমাঞ্চ সবকিছুই ছু্ঁয়ে যেত “ডোরস”এর লেখায়। অবশ্য সব গান মরিসন একা লিখতেন না। মাঞ্জারেক, ক্রিগার দুজনেই বেশ কিছু বিখ্যাত গান লিখেছেন।
গানের আরও একটা দিকের জন্য এই ব্যান্ড প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে, সেটা হল মিউজিক ভিডিও। মরিসন আর মাঞ্জারেক দুজনেই ছিলেন ফিল্মের ছাত্র। শুরুটা এলভিস প্রেসলি করেছিলেন তাঁর সিনেমার গানের মাধ্যমে। কিন্তু একটা ব্যান্ডের গানকে মিউজিক ভিডিও-এর আকারে এইভাবে যে প্রকাশ করা যেতে পারে তা প্রথম “ডোরস”-এর মাথায় আসে। ” ব্রেক অন থ্রু টু দ্য আদার সাইড” এর মাধ্যমে প্রথম মিউজিক ভিডিওর সাথে পরিচিত হয় গোটা দুনিয়া। তারপর একে একে রেকর্ড হয় “আননোন সোলজার”, ” পিপল আর স্ট্রেঞ্জ”। কিন্তু যে গানটি দিয়ে এই চারমূর্তি আমেরিকা জয় করেন সেটি হল “লাইট মাই ফায়ার”।
আমেরিকার এক সংস্হা জানাচ্ছে যে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই “ডোরস”এর বিক্রিত অ্যালবামের সংখ্যা হল ৩২.৫ মিলিয়ন আর গোটা পৃথিবীতে ৯০ মিলিয়ন। মাত্র আট বছর(১৯৬৫-৭৩) অস্তিত্ব ছিল ব্যান্ডটির। তার মধ্যেও প্রায় এক বছর মরিসনের পাগলামি আর মাদকাসক্তির জন্য সেভাবে কোন গান বাজনা বা লাইভ কনসার্ট করতে পারেনি তাঁরা। যদিও মরিসনের মৃত্যুর পর বহুবার চেষ্টা করেছেন এক সাথে গান করার। দুটো একটা ভালো গানও গেয়েছেন কিন্তু সেই ম্যাজিক আর কোনদিনই ফিরে আসেনি মরিসনের অনুপস্হিতিতে। শ্রোতাদের প্রিয় ” লিজার্ড কিং ” স্টেজে উঠতেন হেরোইনের নেশায় চুর হয়ে। স্টেজের পাশেই রাখা থাকতো মদের গ্লাস আর গাঁজা ভরা সিগারেট। একটা করে গান গাইতেন আর একটা করে সিগারেট খেতেন, সঙ্গে মদ। এইভাবে নেশা করতে করতে কতবার স্টেজের উপরেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছেন জিম। কিন্তু মাঞ্জারেক এমনভাবে গান গেয়েছেন যেন মনে হত মরিসনই শুয়ে শুয়ে গান গাইছেন। লাইভ কনসার্টগুলোতে মরিসন গানের সাথে সাথে মুখ দিয়ে অদ্ভুত কিছু শব্দ করতেন, মনে হত যেন ওগুলো গানেরই একটা অংশ। কিন্তু আদতে ওইরকম কোন শব্দের ব্যবহার না ছিল ইংরেজি সাহিত্যে না থাকতো গানের লিরিকে। দর্শক খুবই ভালবাসতো তাঁর এই পাগলামিকে। ১৯৬৯ সালে একবার এক কনসার্টে কিছু দর্শক ও পুলিশের সাথে মরিসনের তুমুল ঝামেলা হয় যা হাতাহাতি অব্ধি গড়ায়। পুলিশ স্টেজ থেকেই গ্রেপ্তার করে তাঁকে। এতে “ডোরস”এর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনার পর আমেরিকায় দারুণ ভাবে সমালোচিত হয় তাঁরা। বেশ কিছুদিনের জন্য থেমে যায় ‘দরজার” আওয়াজ।
আবার “দরজা” খোলার শব্দ শোনা যায় মরিসন হোটেল অ্যালবাম থেকে। তখন গোটা বিশ্ব শুনলো এক অন্য রকম মিউজিক। যে মিউজিকের ইম্প্রোভাইজেশনের কেন্দ্রে ছিল গিটার, ড্রাম আর কিবোর্ডের সন্মিলিত সাউণ্ড এফেক্ট। অবশ্য আরো একটি যন্ত্র সাউণ্ড এফেক্টটিকে পূর্ণতা দিত তা হল মরিসনের গলার আওয়াজ। আওয়াজটি গান গাওয়া ব্যাতিত ব্যবহার হত একটি অতিরিক্ত মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট হিসাবে। এইভাবে সামনে আসে “ওয়েটিং ফর দ্য সান” আর “এল এ ওম্যান” অ্যালবাম দুটি। “এল এ ওম্যান” অ্যালবামের “রাইডার্স অন দ্য স্টর্ম” গানটি সম্ভবত “ডোরস”-এর মিউজিক ইম্প্রোভাইজেশনের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
সেইসময় জিম মরিসনের পাগলামি দেখে একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘোরাফেরা করত, তিনি কি মানসিক বিকারগস্ত??? তাঁকে যখন এই নিয়ে প্রশ্ন করা হত তখন একটি ছোটবেলার গল্প শোনাতেন। একবার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার ধারে অ্যাক্সিডেন্টে মৃত এক রেড ইন্ডিয়ানের দেহ দেখতে পান। যখন তিনি সেই মৃতদেহটি পাশ কাটিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন তখন সেই রেড ইন্ডিয়ানের আত্মা নাকি তাঁর শরীরে ঢুকে পড়ে। এটা শুধু গল্পেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বারবারই তাঁর গানে, কবিতায়, মিউজিক ভিডিওতে উঠে এসেছে এই রেড ইন্ডিয়ান প্রসঙ্গ।
১৯৭১ সালে হঠাৎ মরিসনের গান বাজনার প্রতি মোহভঙ্গ হয়। তিনি ঠিক করেন এবার থেকে শুধুই কবিতা লিখবেন। তাই হঠাৎ “ডোরস” থেকে মুক্তি নিয়ে বান্ধবী পামেলা কারসনের সঙ্গে প্যারিসে চলে যান। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি নিজেই নিজেকে নিয়ে ডকুমেন্টারি শ্যুট করছিলেন। সেখানে বার বার সেই রেড ইন্ডিয়ানের আত্মা প্রসঙ্গে অনেক কথা বলছিলেন। ৩রা জুলাই সকালে বাথটাবের মধ্যে জেমস ডগলাস মরিসনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট থেকে জানা যায় হেরোইনের ওভারডোজের ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটে। মাত্র ২৭বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান জেমস ডগলাস মরিসন। ঠিক তার তিন বছর পর একইরকম ড্রাগ ওভারডোজে তাঁর বান্ধবী পামেলা কারসনও মারা যান।
মরিসন মারা যাবার পর ১৯৭৮ সালে রিইউনিয়ন হয় “ডোরস”-এর। ১৯৭০ সালে রেকর্ড করা ” অ্যান আমেরিকান প্রেয়ার” বলে একটি অ্যালবাম বের করেন তাঁরা জিমের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এখানের দুটো গান খুবই বিখ্যাত হয়, ” দ্য ঘোস্ট সং” আর “রোডহাউস ব্লুজ -লাইভ”। মৃত্যুর সাতবছর পরেও জিম মরিসন একইরকম জনপ্রিয় থেকে যান কারণ “ডোরস”-এর এই শেষ অ্যালবামেরও বিক্রির সংখ্যা ছিল ১মিলিয়ন। এরপর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যায় ” দ্য ডোরস”। ২০১৩ সালে ২০শে মে মারা যান রেমন্ড মাঞ্জারেকও। কিছু ইতিহাস আর একটা তোলপাড় করা সময়কে নিয়ে থেকে যায় তাদের সৃষ্টি করা কালজয়ী গানগুলো।