পরিবেশ

শহর মফস্বলে আলোকদূষণ ও তার প্রভাব

শহর মফস্বলে আলোকদূষণ ও তার প্রভাবশহর মফস্বলে আলোকদূষণ ও তার প্রভাব

কলমে: অরিন্দম রায়

আলোকিত রাত?

 

অতিদ্রুত নগরায়নের এবং জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধিরকারণে শহরাঞ্চল ও মফস্সলের রাতের আকাশ  ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার রাত এবং আলোকিত দিনের চক্রাকার পরিবর্তন কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর বিবর্তনের ফলস্বরূপ প্রাণী এবং উদ্ভিদের ডি.এন.এ বা জিনের মধ্যে স্মৃতির মতই গেঁথে গেছে। পুষ্টি, জনন,  শিকার এবং বিশ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্যিয় প্রক্রিয়া ভীষণভাবে নির্ভরশীল আলো এবং অন্ধকারের ক্রমান্বয়চক্রের উপর। মানুষ এই স্বাঙ্গীকরণ নষ্ট করেছে রাতের পরিবেশে কৃত্তিম আলোক সজ্জার দ্বারা। বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণের পর গোটা পৃথিবী জুড়ে উঁকি দিচ্ছে এক নতুন সমস্যা আলোকদূষণ।

 

সালটা১৯৯৪, আমেরিকার লস এঞ্জেলেস শহরে সদ্য হয়ে যাওয়া ভুমিকম্পের কারনে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বেশ কিছু মানুষ স্থানীয় ইমারজেনসী সেন্টারে টেলিফোন করে জানালেন আকাশে এক বিরাট রূপালি অদ্ভুত বস্তু দেখা যাচ্ছে। পরে জানা গেল, তা আসলে ছায়াপথ। সেই শহরে বড় হওয়া বেশিরভাগ মানুষই কৃত্রিম আলোকের কারনে কখন ছায়াপথ দেখেনইনি।

আলোকদূষণ ও তার প্রভাব

 

সদ্য আবিষ্কার হওয়া এল.ই.ডি বাল্বের ব্যাবহার একই সাথে যেমন বিদ্যুতের সাশ্রয় করেছে তেমনই পরিবেশ বান্ধবও বটে। কিন্তু সাধারন ভেপার লাম্পের তুলনায় নগণ্য দাম হওয়ার দরুন মানুষ অত্যাধিক অপব্যাবহার করছে এল.ই.ডি বাল্বের। বহুক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বলে আমরা সারারাত বাথরুম বা বারান্দার আলো জ্বালিয়ে রেখে দি। শুধুমাত্র রাস্তা ঘাট নয়, বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান বাড়ি এবং বিভিন্ন উৎসবে বহুল ব্যাবহিত হচ্ছে উচ্চ ঔজ্বল্ল আলোক প্রদানকারী ল্যাম্প গুলি। কানাডার টরেন্টো শহরের আলো ঝলমলে অফিস বাড়ি গুলো প্রতিবছর দশ হাজারের উপর চড়ুই, ওয়ব্লার ইদ্যাদি পাখির মৃত্যুর কারন হয়ে ওঠে।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউসের ফ্লাডলাইটে আকৃষ্ট হয়ে প্রতি বছর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে পরিয়ায়ি পাখির ঝাঁক। ফ্লোরিডার উপকূলে সামুদ্রিক কচ্ছপের বাচ্চারা ডিম ফোটার পর সামুদ্রিক ঢেউয়ে প্রতিফলিত চাঁদের আলোয় দিক নির্ণয় করে জলের দিকে এগিয়ে চলে।

কিন্তু বর্তমানে ফ্লোরিডা উপকূলের বিপুল সংখ্যক রিসোর্ট এবং হোটেলের কৃত্রিম আলোকসজ্জায় বাচ্চা কচ্ছপ গুলি দিকভ্রস্ট হয়ে সমুদ্রের উল্টো অভিমুখেযায় এবং সকালের সূর্যের ও তাপে জলের অভাবে হাজার হাজার কচ্ছপ মারা যায়।   আমেরিকার কচ্ছপ সংরক্ষণ কেন্দ্রের অধিকর্তা বিজ্ঞানী ডেভিড গদফ্রের মতে উপকূলবর্তী এলাকায় আলোক প্রদুষন সামুদ্রিক কচ্ছপের বাচ্ছার মৃত্যুর সব থেকে বড় কারন।

কৃত্রিম আলোয় বাচ্চা কচ্ছপ
কচ্ছপ ছানার স্বাভাবিক হেটে যাওয়া (বামদিকে) এবং দিকভ্রষ্ট হয়ে রাস্তায় আসা (ডানদিকে)

 

একনজরে  আলোকদূষণ 

 

 

 

  • জার্মান বৈজ্ঞানিকদের করা সায়েন্স জার্নালে সদ্য প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যাচ্ছে প্রতি বছর পৃথিবীর ২.২% ভূখণ্ড কৃত্তিম আলোয় আলোকিত হচ্ছে এবং ভারতবর্ষে এই হার পৃথিবীর গড়ের প্রায় তিন গুন।.

 

  • প্রতি বছর প্রায় অতিরিক্ত ১.২কোটি টন পরিমান কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরী হয় রাত্রি কালীন কৃত্তিম আলোক সজ্জার জন্য।

 

  • পৃথিবীর ৮০%  শতাংশ মানুষ বর্তমানে কৃত্তিম আলোক দূষণের মধ্যে বসবাস করে।

 

  • আমাজানের গভীর জঙ্গল, তিব্বতের মালভূমি, সাইবেরিয়া, আফ্রিকার কিছু অঞ্চল এখনো অপেক্ষাকৃত কৃত্তিম আলোকদূষণের থেকে মুক্ত।
  • ভারতবর্ষে থর মরুভূমি এবং মধ্যভারতের অরণ্যের সামান্য অঞ্চল ছাড়া বেশির ভাগ অংশই আলোকদূষণে দূষিত।

 

  • রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক যৌথ এক গবেষনাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে রাত্রি কালীন আলোর ক্রমবর্ধমান ধারাকে বিকল্প অর্থনীতির সূচক হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

 

  • বিশ্বের বিখ্যাত তারামণ্ডল গুলি শহরের থেকে অনেক দূরে বানানো হয়েছে যাতে কৃত্রিম আলোক আকাশের গ্রহ –তারা –নিহারিকা দেখতে বাধা সৃষ্টি না করে।

আলোকদূষণ এবং ক্যান্সার ও অন্যান্য 

 

আলোক উৎস থেকে নিস্রিত ফোটন কণা চোখের রেটিনায় পৌঁছানর সাথে সাথে নিউরোনের মাধ্যমে সংকেত পৌঁছে যায় দুই গুরু মস্তিকের মাঝে থাকা পিনিয়াল গ্রন্থিতে। পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে তৈরি হওয়া মেলাটোনিন হরমোন ঘুমের সময় কালিন শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া যেমন দেহের তাপ খর্ব করা, খিদের ইচ্ছে কমানো, বিপাকের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি  নিয়ন্ত্রন করে। পিনিয়াল গ্রন্থি সন্ধের পর থেকে ভোর অব্দি মেলাটনিন নিঃসরণ করে। রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোকের উপস্থিতি রক্তে মেলাটোনিনের স্বাভাবিক ঘনত্বের পরিবর্তন করে যা মানুষের জৈবিক ঘড়িকে প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ, নিদ্রাহীনতা, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং ডাইবে্টিসের মত রোগের সম্ভাবনা অত্যাধিক বারিয়ে তোলে। ২০০৫ থেকে প্রকাশিত হওয়া ১৭ টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ কৃত্রিম আলোকের সাথে ব্রেস্ট এবং প্রস্টেট ক্যান্সারের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে। ২০০১ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিজ্ঞানীদের করা এক অনুসন্ধান বলছে যে রাত্রি কালিন কর্মরত মহিলাদের ক্যান্সার হওয়ার প্রবনতা অন্ধ বা দৃষ্টি হীন মহিলাদের থেকে বহুগুন বেশি।

 

আলোকপ্রদূষণ এবং নাগরিক বাস্তুতন্ত্র 

 

মূলত কৃত্তিম আলোর উপস্থিতি তিন ভাবে প্রভাব ফেলে নাগরিক বাস্তুতন্ত্রের প্রাণীদের উপর। অত্যাধিক আলোর কারণে ছোট্ট স্তন্যপায়ী জীব যেমন ইঁদুর, ছুঁচো, গন্ধগোকুল, কাঠবেড়ালিদের রাতের অন্ধকারে শিকার ধরার ক্ষেত্র কমতে থাকে। ডারউইন ইয়ার ডমাউসের উপর 2006 সালে চালানো এক সমীক্ষা থেকে জানা যায় কৃত্রিম আলোকের উপস্থিতি 15% অব্দি খাদ্যাভাসের অভাব সৃষ্টি করে এবং দৈনিক  4  গ্রামেরও বেশি ওজন কমিয়ে দেয়।

শহরের পাখি এবং পতঙ্গের উপর এই কৃত্রিম আলোর প্রভাব আবার আলাদা। পাখি এবং পতঙ্গ উভয়ই আকৃষ্ট হয় কৃত্রিম আলোর উৎসর দিকে এবং অত্যাধিক উষ্ণতার কারনে ঝলসে গিয়ে বা জলের অভাবে মারা যায় তারা।

আলোকপ্রদূষণ সরাসরি প্রজনন কালীন আচরণে বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ কলকাতায় এবং পার্শবর্তী শহরতলিতে বছর পাঁচেক আগে ও জোনাকির দেখা পাওয়া যেত, কিন্তু বর্তমানে হাতে গোনা কিছু জায়গা ছাড়া জোনাকিদের দেখাই পাওয়া যায়না। কৃত্তিম আলোর প্রজ্বললো এতটাই বেশি  যে তা জোনাকিদের নিজস্ব আলোর উজ্জ্বলতাকে ছাপিয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ জোনাকিদের প্রজননকালীন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একইভাবে কুনোব্যাঙ এবং সোনাব্যাঙের প্রজননের ঋতুতে অত্যাধিক আলো তাদের প্রজনন ডাকের ব্যাঘাত ঘটায়।

আলোর  উৎসব ও উৎসবের  আলো

 

উৎসবের আনন্দে আলোকিত প্রাঙ্গন থেকে আলোকদূষণের প্রবনতা ইদানিং কালে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উদাহরন হিসেবে পাসের ছবিটির দিকে লক্ষ্য করা যাক। এই ছবিটি বানানো হয়েছে নাসার /নোয়ার পরিচালিত কৃত্রিম উপগ্রহ সউমি থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে। পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাচ্ছে ইংরেজি নববর্ষের সময় ভারতবর্ষে ব্যাবহিত নানাবিধ আলোকসজ্জার এবং তার ঠিক ১০ দিন আগের আকাশের মধ্য কারবি পুল পার্থক্য। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, উৎসবের কারণে কৃত্তিম আলোর ব্যবহার শুধুমাত্র উৎসবের দিন গুলিতে হয়না, উৎসবের পরও উৎসবের রেশ বজায় রাখতে বেশ কিছুদিন রাখা হয়। যেমন ইংরেজি নববর্ষের পর প্রায় 7 দিন অব্দি ভারতবর্ষের উপর আলোকদূতির কোনো পরিবর্তন হয়না।

জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার বিজ্ঞানী পবন কুমারের নেতৃত্বে করা সদ্য প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে ২০০৩ এর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে আলোকপ্রদূষণ বেড়েছে ৭ গুণেরও বেশি। অথচ আলোকদূষণ কমানোর পথ খুবই সহজ। অকারনে আলোর ব্যাবহার কমানো, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টেটা ইমার লাগানো, আলোক উৎসের তিব্রতা কমানো এবং ১০ ফুটের বেশি উচ্চতায় ল্যাম্পপোস্টনা লাগানোর মতো অত্যন্ত সাধারন কিছু পদ্ধতি অবলম্বনেই শুধুমাত্র আলোকদূষণ যে কমবে তাই নয় বহু টাকার বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হবে।

আলোকদূষণের বর্ধনশীলতা (২০০২ এবং ২০১২)
আলোকদূষণের বর্ধনশীলতা  (২০০২ এবং ২০১২)
উৎসবের আগে এবং উৎসবের দিনে আলোকদূষণে রমানচিত্র
উৎসবের আগে এবং উৎসবের দিনে আলোকদূষণে র মানচিত্র

শেষের কথা

 

পরিযায়ী পাখিদের যাতায়াতের ঋতুতে টরেন্টো, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটনের মতো শহরে রাতের বেলা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।  আরিজোনার ফ্ল্যাগস্টাফ প্রথম শহর হতে চলেছে যেখানে সম্পূর্ণ ভাবে রাতের অন্ধকার আকাশকে প্রাধান্য দিয়ে বানানো হচ্ছে। কানাডার এক জ্যাসপার নামের এক ছোট্ট শহরে আট বছর ধরে রাত্রের আকাশ দেখার জন্য হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসী মানুষ ভিড় জমান। ভাবুন না, যদি আপনার শহরেও করা যায় এরকম অন্ধকার উৎসব, তাতে পরিবেশ বাঁচবে, বাঁচবে মানুষ আর উপার্জনও হবে অনেকের।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

জানা অজানা তথ্য

Leave a Reply