পরিবেশ

বিপদ ডেকে আনতে পারে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ

বিপদ ডেকে আনতে পারে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জবিপদ ডেকে আনতে পারে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ

কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ

 

শহর ছাড়িয়ে একটু গ্রামের দিকে গেলেই ঠাণ্ডা মিষ্টি হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দেয় আমাদের। শহর এবং গ্রামের এই উষ্ণতার তারতম্যের প্রতি সম্প্রতি অত্যন্ত বিষদ গবেষণা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে। ২০১৪-২০১৫ সাল থেকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে হিট ওয়েভের সংখ্যার আকস্মিক বৃদ্ধি ঘটে। জেলা সদরগুলিতেও এর প্রভাব পড়ে। ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা হিট ওয়েভের সংখ্যা বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানী মহলে দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাড়ায়। এর কারন, বর্তমান অবস্থা এবং প্রভাব নিয়ে নতুন ভাবে শুরু হয় গবেষণা। স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানিরা জানান হিট ওয়েভ হিমশৈলের চূড়া মাত্র। দ্রুত নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিনামে গ্রাম এবং শহরের দুরত্ব যত কমে আসছে, ততই ফারাক বাড়ছে গ্রাম এবং শহরের তাপমাত্রার। শহরগুলিকে ডাকা হচ্ছে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ নামে।

 

শুরুর কথা

 

লিউক হাওয়ার্ড আসলে ছিলেন এক কেমিস্ট। সময়টা ১৮শ শতকের লন্ডন। পেশায় কেমিস্ট হলেও নেশা ছিল শহরের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ। প্লেস্টো, টটেনহাম আর স্টান্ডফোর্ড তখন গ্রাম। লিউক সেই তিন গ্রাম আর আর লন্ডনের বিখ্যাত রয়াল সোসাইটির উষ্ণতার সূচক চার পর ধরে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, লন্ডন শহর তার অট্টালিকা, জনবহুলতা এবং আগুনের জন্য অত্যাধিক ব্যবহৃত জ্বালানির কারনে পারিপার্শিক গ্রামের তুলনায় ২.১℃ উষ্ণতর। অর্থাৎ তৎকালীন ইংল্যান্ডের বুকে ছড়িয়ে থাকা সহর গুলি যেন ঠিক যেন এক দ্বীপ পুঞ্জের মত। যেখানে উষ্ণতা পারিপার্শিক গ্রামগুলির টজকে অনেকটাই বেশি।   সময়ের তুলনায় অনেকটাই আগে থাকার দরূন লিউকের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠেন তৎকালীন আবহাওয়াবিদরা।

১৮শ শতকের লন্ডন থেকে ফেরা যাক বর্তমান সময়ে। ইতিহাসের পাতা খুলে ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোর বিজ্ঞানী ইয়ান স্টুয়ার্ট প্রমান করলেন, ইতিহাসের দিকে নজর না দেওয়ার ফলে শহুরে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ গুলির সম্পর্কে সময়াচিত জ্ঞান অর্জন বহুলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।

যদিও আমরা টর্নেডো, সুনামি বা হ্যারিকেনের বিধ্বংসী রূপ নিয়ে বেশি চর্চা করি, কিন্তু প্রতি বছর শহুরে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ গুলির দ্বারা এদের থেকেও কয়েক গুণ মানুষের বেশি মৃত্যু ঘটে।

 

বৈজ্ঞানিক কারণ

 

প্রতিটি বস্তুই আলোক শোষণ এবং প্রতিফলন করে। এটি নির্ভর করে বস্তুর রঙের ওপর যে সেটি কোন ধরণের আলো কোনো শোষণ করবে এবং কোন ধরণের আলো প্রতিফলন করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সবুজ রঙের বস্তু সবুজ আলোর প্রতিফলন করে এবং বাকি সমস্ত আলোর শোষণ করে। সবুজ আলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা গাছের পাতাকে সবুজ দেখতে পাই। একই ভাবে গাঢ় রঙের বস্তু বেশি আলোক শোষণ করে হালকা রঙের বস্তুর তুলনায়। কালো রঙের বস্তু সব ধরণের আলোই শোষণ করে নেয় এবং সাদা রঙের বস্তু সমস্ত আলোই প্রতিফলিত করে।

শহরাঞ্চলে রাস্তাঘাট, বাড়ির ছাদ এবং অন্যান্য জায়গায় পিচের ব্যবহার সূর্যের আলোকে সম্পুরর্ণভাবে শোষণ করে। কংক্রিটও আলোক শোষণ করে উষ্ণতার বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উপরন্তু শহরের বাড়ি ঘরদোর গ্রামের তুলনায় অনেকটাই ঘিঞ্জি থাকার দরুন উষ্ণতা কমতে অনেকটাই সময় লাগে। গাছের অভাবও অনেকাংশে শহরে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। দিনেরবেলায় গাছের পত্ররন্ধ্র থেকে নিঃসৃত জল হাওয়ার দ্বারা বাষ্পীভূত হয়ে পারিপার্শিক বাতাসকে ঠান্ডা রাখে। ঠিক যেমন, ঘেমে ওঠার পর হাওয়ার সামনে দাড়ালে ঠান্ডা লাগে। গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে যোগ হয়েছে অত্যাধিক এয়ার কন্ডিশনার এবং গাড়ির ব্যবহার। দুটি ক্ষেত্রেই প্রচুর পরিমানে তাপ সরাসরি পরিবেশে মিশে পারিপার্শিক আবহাওয়াকে উষ্ণতর করে তোলে।

 

বিপদে বঙ্গ

 

এনার্জি রিসার্চ ইন্সিটিউটের তথ্য অনুযায়ী দিল্লি, জয়পুর, আমদাবাদ, ভোপাল, কলকাতা, গৌহাটি, পাটনা সহ দেশের ১৩ টি শহরের তাপমাত্রা পারিপার্শ্বিক গ্রামাঞ্চলের থেকে ২-৭˚ সেলসিয়াস অব্দি বেশি। সমগ্র দেশের উষ্ণতার মানচিত্র দেখলে শহরাঞ্চল গুলিকে সম্পূর্ণ আলাদা দ্বীপপুঞ্জের মত মনে হয় যেখানে তাপমাত্রা নিকটবর্তী এলাকার তুলনায় অনেকটাই বেশি। আবহাওয়ার চরিত্রগত ভাবে দিল্লি বা উত্তর ভারতের শহরগুলির তুলনায় গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলি আলাদা কারন সমুদ্রের উপস্থিতি এখানের বাতাসে আপেক্ষিক আদ্রতার পরিমান বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। মনে করুন, বছরের কোন একদিনে দিল্লি এবং কলকাতা উভয়েরই তাপমাত্রা ৩৫˚ সেলসিয়াস। কিন্তু দিল্লিতে আপেক্ষিক আদ্রতা ৪০% এবং কলকাতায় ৮৫%। আপনি যদি দিল্লিতে থাকেন তাহলে তাহলে আপনার শরীর ৩৭˚ সেলসিয়াস তাপমাত্রা অনুভব করবে, কিন্তু আপনি যদি কলকাতাতে থাকেন তাহলে আপনার শরীর প্রায় ৬০˚ সেলসিয়াস অনুভব করবে আপেক্ষিক আদ্রতা বেশি হওয়ার দরুন। উষ্ণতার সাথে আপেক্ষিক আদ্রতার এই যৌথ সমাহার উষ্ণদ্বীপপুঞ্জগুলিকে বাংলার মানুষের জন্য আরো হানিকারক করে তুলেছে।

 উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ

    শহর কলকাতার তাপমাত্রা। লাল জায়গা গুলী বেশি উষ্ণ, হলুদ গুলি অল্প উষ্ণ। সহরকেন্দ্রে পারিপার্শ্বিকের তুলনায় অধিক তাপমাত্রা সৃষ্টি করেছে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জের।

প্রভাব

 

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে প্রকাশ, উপরিউর্জ বেড়ে চলা বেড়ে চলা এই শহরাঞ্চলের উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ গুলি ২০১৩-২০১৬ সালের মধ্যে ৪০০০ এরও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ নিয়েছে। ২০১৭ সালে, দিল্লি এবং মুম্বাই আই. আই. টি এর বিজ্ঞানীরা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীদের সাথে এক যৌথ প্রবন্ধ বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা সায়েন্সে প্রকাশিত করেন। সেখানে তারা দেখান যে মাত্র ০.৫℃ তাপমাত্রা বাড়ার ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ১০০ এর অধিক মানুষের প্রাণহানির সম্ভবনা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। উষ্ণদ্বীপপুঞ্জগুলি ভারতীয় মেট্রো শহরগুলিতে ৩-৪℃ তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে যা হিট স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা, ক্লান্তির মতো বিভিন্ন রোগ এবং উপসর্গ সৃষ্টি করে।

শুধু স্বাস্থ্য ক্ষেত্র নয়,শহুরে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়িয়ে তোলে যা পরোক্ষভাবে বিশ্বউষ্ণায়নকারি গ্রিন হাউস গাসগুলির নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়।

শুধুমাত্র মানুষ না, শহরাঞ্চলের উষ্ণদ্বীপপুঞ্জ গুলি বিপন্ন করে তুলছে শহরের জৈববৈচিত্রকে। বিভিন্ন পাখি, পতঙ্গ, বেজি, গন্ধগোকুল, গেকো, ব্যাঙ বা সাপেদের সংখ্যা এই উষ্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে কমতে শুরু করেছে। শীতল রক্তের প্রানিরা, যারা পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার সাথে নিজের শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন করতে অক্ষম ( যেমন সরীসৃপ ও উভচর), আরও বেশি মাত্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

সমাধানের পথ

 

সম্প্রতি ইউনাইটেড নেসানের এক রিপোর্টে প্রকাশ, ২০৫০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বসবাস করবে। বিশ্বউষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে উষ্ণদ্বীপপুঞ্জের এই সমস্যার প্রভাব যে সুদূরপ্রসারী তা বলাই বাহুল্য। তাহলে কি এই সমস্যা সমাধানের জন্য নাগরিক উন্নয়ন বন্ধ করতে হবে? বিজ্ঞানিরা জানাচ্ছেন তা কখনোই নয়। উপায় আছে হাতের কাছেই। আমেরিকার এনভায়রনমেন্ট প্রটেকসান এজেন্সির বিজ্ঞানীরা বলছেন হালকা রঙের কংক্রিট ব্যাবহারের ফলে ৫০% অব্দি কমতে পারে উষ্ণতা। ২০১৭ সালে আমেদাবাদের একটি এলাকায় একসাথে ৩০০০ টি বাড়ির ছাদ চুন-সুরকি এবং প্রতিফলনকারি রাসায়নিক দিয়ে সাদা রঙ করার ফলে বাড়ির ভেতরের তাপমাত্রা সর্বচ্ছ ৭˚ সেলসিয়াস অব্দি কমে গেছে। আর একটি সহজসাধ্য উপায় হল ছাদ-বাগান এবং বিভিন্ন শহরাঞ্চলের কংক্রিটের কাঠামোগুলিকে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঢেকে ফেলা। শহরে সবুজ এলাকা বাড়ানো এবং জলাধারগুলির রক্ষণাবেক্ষণ অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে উষ্ণতা।

আমেদাবাদের সাদা ছাদ প্রোজেক্ট
আমেদাবাদের সাদা ছাদ প্রোজেক্ট
সাদা ছাদ ও কাঠামো কমিয়ে দেয় তাপমাত্রা
সাদা ছাদ ও কাঠামো কমিয়ে দেয় তাপমাত্রা
ছাদ-বাগান
ছাদ-বাগান
জানা অজানা তথ্য

Leave a Reply