কলমে : সুমন্ত বাগ
এই মানুষটিকে নিয়ে লেখা আমার কম্ম নয়। কারণ যদি সত্যি ভগবান থেকে থাকেন তাহলে আমার মনে হয় তিনি সচিন তেন্ডুলকর । কারণ ভগবান তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকেন। ক্রিকেট মাঠের মধ্যে তাঁকে ছোঁয়া এক কথায় অসম্ভব। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি কারণ আমি তাঁর খেলা দেখে বড় হয়েছি, ক্রিকেট খেলা বুঝতে শিখেছি। ছোটবেলায় যখন ক্রিকেট কিছুই বুঝতাম না তখন দেখতাম একটা বেঁটে লোক ব্যাট হাতে নামছেন আর চার মারছে। সবাই সেটা দেখে আনন্দ করআতো, লাফালাফি করতো, আমিও করতাম। আর বড় হয়ে জানলাম এই মানুষটি শুধু ক্রিকেট মাঠে নয় মাঠের বাইরেও একজন মহীরুহ। শুভ জন্মদিন ক্রিকেট ঈশ্বর।
সচিন তেন্ডুলকর জীবন বা খেলা নিয়ে অনেক ভালো ভালো জিনিস লেখা হয়েছে। আমি তার জীবনের দশটি দিন তুলে ধরলাম, যেদিনগুলো তাঁকে অমরত্বের চূড়ায় তুলে নিয়ে গেছে হয়তো।
১. ১৫ই নভেম্বর ১৯৮৯
১৬ বছরের সচিনের করাচিতে অভিষেক হয় এই দিনটিতে। সদ্য ইরানি ট্রফি অভিষেকে সেঞ্চুরি করে তিনি পাকিস্তান সফররত ভারতীয় দলে সুযোগ পান।
মাত্র ১৫ রান করে ইউনিসের বলে বোল্ড হয়ে যান প্রথম ইনিংসে। আর ২য় ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ আসেনি।
২. ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৮৯
৮৯-এর পাকিস্তান সিরিজে সচিনের সাথে টেস্ট অভিষেক হয় ওয়াকার ইউনিসের। সিরিজের বাকি তিনটি টেস্টে ইমরান – আক্রম- ইউনিস- কাদির সমৃদ্ধ সেইসময়কার বিশ্বসেরা বোলিং অ্যাটাক দক্ষতার সাথে সামলে দিয়েছিলেন সচিন। কিন্তু দুর্ঘটনাটি ঘটে শিয়ালকোটে চতুর্থ টেস্টের ২য় ইনিংসে। ওয়াকার ইউনিসের এক ভয়ংকর বাউন্সার আছড়ে পড়ে সচিনের নাকে। যথারীতি নাক ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে। ফিজিও মাঠে ঢুকে শুশ্রূষা করে রক্ত বন্ধ করে দেন। সেদিন নন স্ট্রাইকার এন্ডে ছিলেন নভজ্যোত সিং সিধু। তিনি ও ফিজিও সচিনকে ড্রেসিংরুমে যাবার পরামর্শ দেন। কিন্তু তখন ভারতের ৩৮ রানে ৪ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তারপর সচিনের মুখ থেকে বেরোয় সেই অমোঘ উক্তিটি, ” ম্যায় খেলেগা।” সেদিনের সেই বাউন্সারে এক মহানায়কের জন্ম দিয়ে যায়।
৩. ১৪ই আগস্ট ১৯৯০
ওল্ড ট্রাফোর্ডে ২য় টেস্টের চতুর্থ ইনিংস। ১২৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ভারতের সামনে হারের হাতছানি। এমন সময় মাঠে নামেন সচিন। প্রথমে কপিল দেব ও পরে মনোজ প্রভাকরকে নিয়ে ৫ম দিনের উইকেটে হারা টেস্ট ম্যাচ ড্র করে দেন। ২২৫ মিনিট ব্যাট করে ১৮৯ বল খেলে ১১৯ রান করেন। এটিই ছিল সচিনের জীবনের প্রথম সেঞ্চুরি।
৪. ২৪শে নভেম্বর ১৯৯৩
হিরো কাপ সেমিফাইনালে সাউথ আফ্রিকার মুখোমুখি ভারত। প্রথমে ব্যাট করে মাত্র ১৯৫ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। ১৯৬ রানের লক্ষ্যমাত্রা সেই সাউথ আফ্রিকার কাছে কোনভাবেই যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু প্রতিটি ভারতীয় বোলারের কৃপণ বোলিং ম্যাচটি শেষ ওভারে নিয়ে আসে যেখানে শেষ ওভারে মাত্র ৬ রান দরকার ছিল সাউথ আফ্রিকার। এরপর শুরু হয় সচিন ম্যাজিক। ক্যাপ্টেন আজাহারের সাথে কথা বলে নিজের হাতে বল তুলে নেন লিটল মাস্টার। মাত্র তিন রান দিয়ে ছিলেন শেষ ওভারে। ভারত ২ রানে জয়ী হয়।
৫. ২৭ মার্চ ১৯৯৪
অনেকে বলেন সনৎ জয়সূর্য নাকি একদিনের ক্রিকেটে ওপেনারদের ভূমিকা পাল্টে দেন তার বিস্ফোরক ব্যাটিং দিয়ে। কিন্তু সচিনের প্রথম ওপেনিং ইনিংস কম বিস্ফোরক ছিল না। অকল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি করেছিলেন ৪৯ বলে ৮২। তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। ওপেনিং-এর সাথে তাঁর প্রেম হয়ে যায়।
৬. ১লা এপ্রিল ১৯৯৮
ব্যাটসম্যান সচিনের খ্যাতি ততদিনে সর্বজনবিদিত। কিন্তু বোলার সচিনের আত্মপ্রকাশ হয় এইদিনে। কোচিতে একদিনের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিংকে স্পিন বোলিংয়ে শুইয়ে দিয়ে জীবনের প্রথম ৫ উইকেট নেন। সচিনের শিকারগুলি হল মাইকেল বেভান, স্টিভ ওয়া, ড্যারেন লেম্যান, টম মুডি এবং ড্যামিয়েন মার্টিন আর বোলিং ফিগার হল ১০-১-৩২-৫।
৭. ২২শে এপ্রিল১৯৯৮
অস্ট্রেলিয়ানরা ডন ব্র্যাডম্যানের পর আতিমানবিক ইনিংস খেলতে আর কাউকে দেখেনি। কিন্তু সচিনের শারজা কাপের ইনিংস দুটি অস্ট্রেলিয়ানদের বাধ্য করেছিল বিশ্বাস করতে যে ব্র্যাডম্যান ছাড়াও অতিমানবিক ইনিংস খেলার ক্ষমতা রাখেন এই বেঁটে লোকটি। উল্টোদিকে একের পর এক উইকেটের পতন, মরুঝড়, অস্ট্রেলিয়ানদের কুখ্যাত স্লেজিং কোন কিছুই আটকাতে পারেনি সেদিন সচিনকে। প্রাক টি টোয়েন্টি যুগে ৯টি চার ও ৫টি ছয়ের সাহায্যে ১৩১ বলে ১৪৩ রানের ইনিংস খেলে ভারতকে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে তোলেন। ম্যাচটি ভারত হেরে যায় কিন্তু এই ইনিংস সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। এর ঠিক দুদিন পর অর্থাৎ ২৪শে এপ্রিল ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আবার সেঞ্চুরি করে ভারতকে শারজা কাপ জেতান। এবার করেন ১৩১ বলে ১৩৪।
৮. ১লা মার্চ ২০০৩
বিশ্বকাপে গ্রুপলীগে মুখোমুখি ভারত পাকিস্তান। টসে জিতে আগে ব্যাট করে পাকিস্তান ভারতকে ২৭৪ এর লক্ষ্যমাত্রা দেয়। পাকিস্তানের বোলিং ব্রিগেড গড়া আক্রম,ইউনিস, আখতার, রাজ্জাক ও আফ্রিদিকে নিয়ে। ইনিংস বিরতিতে সব বিশেষজ্ঞই পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখছিলেন তাদের বোলিং অ্যাটাকের জন্য। ভারতের সম্বল ছিল শুধুই ওয়ার্ল্ডকাপে পাকিস্তানের কাছে না হারার রেকর্ড আর একজন সচিন তেন্দুলকর। সেহবাগ পরবর্তীতে অনেক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “সেদিন যখন আমরা পিচের দিকে যাচ্ছি তখন আমি সচিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি করা যায়? উত্তরে সচিন আমাকে বলেছিলেন আমি ফেস করছি। তুই নন স্ট্রাইকারে যা।” পরে নিজের জীবনীতে সচিন লিখেছেন ওটাই ছিল তাঁর খেলা জীবনের সেরা ওয়ানডে ইনিংস ৭৫ বলে ৯৮।
৯. ২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০১০
মিডিয়া আর সমালোচকরা যখন তাঁকে অবসরে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে পাতার পর পাতা লিখে কাগজ ভরিয়ে ফেলছেন ঠিক তখনই সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে গোয়ালিয়রে বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে ওয়ানডেতে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস খেলেন সচিন তেন্ডুলকর ।
১০. ২রা এপ্রিল ২০১১
জীবনের এই দিনটিকে তিনি আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন স্বপ্নপূরণের দিন হিসাবে। ক্রিকেট ঈশ্বরের হাতে অবশেষে ধরা দেয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ, যে বিশ্বকাপ ছোঁয়ার জন্য তিনি মোট ৬টি বিশ্বকাপ খেলেছেন এবং মোট রান করেছেন ২২৭৮। এই রাতেই সচিন তেন্ডুলকর ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।