কলমে: সুমন্ত বাগ
কবিতার ছন্দ আর ছবির সৌন্দর্য স্রষ্টার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা এমন এক সূক্ষ্ম অনুভূতি যা শুধুমাত্র সাদা পাতাতেই বেরিয়ে আসে। আপনি যদি কোন রঙিন কাগজে আঁচড় কাটেন তাহলে সেই আঁচড়, কাগজের রঙে আপনার চোখে ধরা দেবে। কিন্তু সাদা পাতার আঁচড়কে আপনি ইচ্ছে মত আপনার খুশির রঙে রাঙাতে পারবেন। মনের ভাব প্রকাশের অভিব্যক্তি খুবই সূক্ষ্ম হয়। এই সূক্ষ্মতার মাত্রাগুলো প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্বতা দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে, যা শিল্পগুলোকে কালজয়ী করে তোলে। এমনই একজন ফুটবল মাঠের শিল্পী হলেন মিশেল প্লাতিনি। ফুটবলের সবচেয়ে সূক্ষ্ম জিনিস হল টাচ। একটা টাচ খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। প্লাতিনির ফুটবল দাঁড়িয়ে ছিল তিনটি জিনিসের ওপর। স্কিল, প্রখর ফুটবল বুদ্ধি আর শৈল্পিক টাচ।
আত্মপ্রকাশ ও বিস্তার
আজকের ফরাসি ফুটবল আর প্লাতিনিপূর্ব ফরাসি ফুটবল, এই দুইয়ের ব্যবধান প্রায় সহস্র যোজন। ১৯৫৮ এর বিশ্বকাপে কোন এক জ্যাঁ ফত্যাঁর মূলপর্বে ১৩টি গোলের বিশ্বরেকর্ড ছাড়া আর কিছুই ছিল না ফরাসি ফুটবলে। ১৯৭২ সালে ফুটবল মাঠে আত্মপ্রকাশ ঘটে মিশেল প্লাতিনির। ন্যান্সির হয়ে প্রফেশনাল ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। তারপর ফরাসি ফুটবলের নবজাগরণ শুরু হয়। পাশে পেয়েছিলেন মিশেল হিদালগোর মত এক ধুরন্ধর কোচ। হিদালগোর প্রথম ম্যাচ থেকেই প্লাতিনি ছিলেন অটোমেটিক চয়েস। গুরু-শিষ্যের বোঝাপড়ায় ১২ বছর পর ফ্রান্স ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ২৩ বছরের প্লাতিনির সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস, ফ্রান্সের সাথে সেই গ্রুপে ছিল ৭৪ এর ফাইনালিস্ট ইতালি আর আয়োজক আর্জেন্টিনা। প্রথম ম্যাচে ইতালির মুখোমুখি হয় ফ্রান্স। আজুরি কোচ এঞ্জো বেয়ারজোত খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিলেন প্লাতিনির খেলা। সেই ম্যাচে মার্কো তারদেল্লিকে তিনি দায়িত্ব দেন প্লাতিনিকে আটকানোর। ফ্রান্স ২-১ গোলে হেরে যায়। পরের ম্যাচটি ছিল আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে। ড্যানিয়েল পাসারেল্লার অল রাউন্ড ফুটবলের কাছে সেই ২-১ গোলেই হার স্বীকার করতে হয় ফরাসিদের। ফ্রান্সের একমাত্র গোলটি আসে প্লাতিনির পা থেকে কিন্তু দুটো ম্যাচ হেরে প্রথম রাউন্ডেই তাদের বিদায়ঘন্টা বেজে যায়।
১৯৮২ঃ স্পেন ওয়ার্ল্ডকাপ ও ম্যাজিক স্কোয়্যার
আজ পর্যন্ত আমরা যতগুলো গ্রেট টিমের উত্থান দেখেছি তাদের প্রত্যেকের একজন করে নেতা ছিলেন। সেই টিমের কোচের ভাবনা চিন্তাগুলো মাঠে সফলভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা নিতেন। এছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত স্কিলের বিচ্ছুরণে আলোকিত হত গোটা টিম। জার্মানির বেকেনবাওয়ার, হল্যান্ডের ক্রুয়েফ, আর্জেন্টিনার মারাদোনার মত ফ্রান্সের তৎকালীন টিমের নেতা ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। ৮০ -র দশকে প্লাতিনির ফ্রান্সকে “ইউরোপের ব্রাজিল” বলা হত। অসাধারণ ফাইন টাচ ফুটবলের দরুন গোটা বিশ্বের মন জয় করেছিলেন প্লাতিনি। ফুটবলটা খেলতেন মস্তিষ্ক দিয়ে। কখনোই প্রয়োজনের বেশি এক মূহুর্ত পায়ে বল রাখতেন না। বল ধরা ও ছাড়ার এই নিঃখুত সময়জ্ঞান বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ধাঁধায় ফেলে দিত।
প্রথম দর্শনে তাঁকে “বাবু প্লেয়ার” বলে ভুল হতে বাধ্য, কারণ কখনোই তিনি বেশি ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে যেতেন না। কিন্তু তাঁর একটা কি দুটো টাচে কিংবা ডিফেন্সচেরা ফাইনাল থ্রুতে পুরোপুরি বেআব্রু হয়ে পড়ত বিপক্ষের রক্ষণব্যবস্থা।পেনিট্রেটিং জোনে প্লাতিনির পায়ে বল পড়লে আর রক্ষে নেই, তাঁর বিখ্যাত ডান পা ঝলসে উঠবেই। এরসাথে যুক্ত হয়েছিল অব্যর্থ ফ্রিকিক নেওয়ার ক্ষমতা। কৃত্রিম মানব প্রাচীর তৈরি করে ফ্রিকিকে গোল করাটা প্রায় জলভাত করে ফেলেছিলেন। ফুটবল মাঠে প্লাতিনির উপস্হিতি অনেকটা ঠান্ডা কাঁচের ঘরে বসে থাকা কোন কোম্পানির বিজনেস এক্সিকিউটিভের মত। ক্ষুরধার মস্তিষ্ক দিয়ে তিনি যেমন কোম্পানির ব্যবসার প্রসার ঘটান ঠিক তেমনি পিছন থেকে বাড়ানো প্লাতিনির ফাইনাল পাসগুলো তাঁর সতীর্থদের সামনে গোলের মুখ খুলে দিত।
তিগানা, গিরেস ও ফার্নান্ডেজের সঙ্গে প্লাতিনির উপস্হিতি ফ্রান্সের মাঝমাঠকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ১৯৮২ এর স্পেন ওয়ার্ল্ডকাপে ফ্রান্সের এই চর্তুভুজের দাপটে ম্লান হয়ে যায় ব্রাজিলের জিকো-ফ্যালকাও-সক্রেটিস-ক্যারেকা সমৃদ্ধ স্বপ্নের মাঝমাঠ। ফুটবলপ্রেমী ও মিডিয়া ফ্রান্সের এই চর্তুভুজের নামকরণ করেন “ম্যাজিক স্কোয়্যার”। ভালো ফুটবল উপহার দিলেও সেবার কাপ জিততে পারেননি প্লাতিনিরা। সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে এগিয়ে থেকেও অতিরিক্ত সময়ে রুমেনিগের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কাছে হেরে যেতে হয়। কিন্তু ফরাসি পারফিউমের মত ফরাসি ফুটবলের সৌরভ তখন থেকেই প্রায় গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
৮৪-এর ইউরোপিয়ান কাপ ও প্রথম ট্রফি জয়
১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫ টানা তিনবার ব্যালন ডি অর জিতে প্রথমবারের জন্য ব্যালন জেতার হ্যাট্রিক করেন প্লাতিনি। তাই ৮৪ তে ইউরোপিয়ান কাপে তিনিই ছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা তারকা। ৮২এর বিশ্বকাপের যন্ত্রণা ভুলতে নিজের দেশে ইউরো কাপ জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্লাতিনি। সেবার তাঁর নেতৃত্বে “ম্যাজিক স্কোয়্যার” যে ফুটবল খেলেছিলেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ইউরোর ইতিহাসে। প্রথম ম্যাচে ডেনমার্কের ডিফেন্স ভেঙে ৭৮ মিনিটে জয়সূচক গোলটি আসে প্লাতিনির পা থেকে। পরের ম্যাচে বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে তাঁর পারফেক্ট হ্যাট্রিকের (বাঁ পা, ডান পা ও হেডে গোল) দরুন ৫-০ তে ম্যাচ জেতে ফ্রান্স। তারপর গ্রুপের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় যুগোস্লাভিয়ার। ৩-২ গোলে ম্যাচটি জেতে ফ্রান্স। এই ম্যাচেও হ্যাট্রিক করেন প্লাতিনি।
সেমিফাইনালে ফ্রান্সের সামনে পড়ে পর্তুগিজরা। এইম্যাচে ফেভারিট হিসাবে শুরু করে ফরাসিরা এবং ২৪ মিনিটেই ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। তারপর একের পর এক গোলের সহজ সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হয় গিরেস, ফার্নান্ডেজদের। ধীরে ধীরে ম্যাচে ফিরে আসে পর্তুগাল। গোলে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন পর্তুগিজ ক্যাপ্টেন ম্যানুয়েল বেন্তো। সেকেন্ড হাফে প্রায় চারটি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে পর্তুগালকে ম্যাচে রাখেন বেন্তো। ৭৪ মিনিটে বেন্তোর লড়াইয়ের সন্মান রাখেন জোরাদো, হেডে গোল করে সমতা ফিরিয়ে আনেন। অতিরিক্ত সময়ে পর্তুগিজরা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফরাসিদের ওপর এবং ৯৮ মিনিটে গোল করে এগিয়ে যায়। যখন স্বপ্নভঙ্গের আশায় গোটা স্টেডিয়াম প্রায় মুহ্যমান তখন গিরেসের একটা বল ধরে দুজনকে কাটিয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন প্লাতিনি। শট মারতে যাবেন, এমন সময় তাঁকে দুজন পর্তুগিজ ডিফেন্ডার ব্লক করেন। ফিরতি বল গোলে পাঠিয়ে দেন প্লাতিনির ঠিক পিছনে দাঁড়ানো লেফট ব্যাক দোমার্গে। খেলার রেজাল্ট ২-২।
১১৮ মিনিটেও ফয়াসলা না হওয়ায় ট্রাইব্রেকারের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুই শিবির। ঠিক তখনই ঝলসে ওঠেন প্লাতিনি। তিগানার মাইনাস বক্সে রিসিভ করে দেখলেন তিনজন ডিফেন্ডার ও গোলকিপার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। ঠান্ডা মাথায় একটা টাচে তিন ডিফেন্ডারকে মাটি ধরিয়ে দিলেন এবং ছোট্ট টোকায় বলটা জালে জড়িয়ে দিলেন।
১১৯ মিনিটের গোলের পর আর পর্তুগিজরা সমতা ফেরাতে পারেনি। ৩-২ গোলে জিতে প্রথম ফিফা পরিচালিত কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে ফ্রান্স।
ফাইনালে স্পেনকে ২-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবার ইউরোপ সেরা হয় ফরাসিরা। ৫৭ মিনিটে প্লাতিনিই গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন। ৫ ম্যাচে ৯টা গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়রের পুরস্কার পান মিশেল প্লাতিনি।
জুভেন্টাস ও স্বপ্নের দৌড়
১৯৮২ থেকে ৮৭ পর্যন্ত ছিল প্লাতিনির স্বপ্নের ফর্ম। আর এই সোনার সময় তিনি কাটিয়েছেন ইতালিয়ান জায়ান্ট জুভেন্টাসে। ৮৩ ও ৮৫ তে দুবার সিরি আ খেতাব জেতেন। ৮৪ তে জেতেন ইউরোপীয়ান কাপ যা বর্তমানে চ্যম্পিয়ান্স লীগ নামে খ্যাত। এছাড়াও জুভেন্টাসের হয়ে জেতেন ইউরোপীয়ান সুপার কাপ, কোপা ইতালিয়া ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। মাইকেল লড্রুপের সাথে প্লাতিনির বোঝাপড়া ছিল দেখার মত। কিন্তু প্লাতিনি কোনদিনই ফিটনেস নিয়ে সচেতন ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিল, “আমরা তো অলিম্পিকে ৫০০০ মিটার দৌড়াতে যাচ্ছি না! আমাদের তো শুধু পা দিয়েই খেলতে হবে।” ১৯৮৭ সালে মাত্র ৩২টি বসন্ত পার করে ফুটবলকে বিদায় জানান এই মহাতারকা। যদি একবার প্লাতিনির ফুটবল ক্যারিয়ারে নজর দেওয়া হয় তাহলে পরিস্কার হয়ে যাবে কি কতৃত্বের সাথে তিনি ফুটবলটা খেলেছেন।
পজিশন
* আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার
ক্লাব ক্যারিয়ার
* ১৯৬৬-৭২ : অ্যাজ জিওফ
* ১৯৭২-৭৯ : ন্যান্সি ১৮১ ম্যাচে ৯৮ গোল
* ১৯৭৯-৮২ : সেইন্ট এঁতে ১০৪ ম্যাচে ৫৮ গোল
* ১৯৮২-৮৭ : জুভেন্টাস ১৪৭ ম্যাচে ৬৮ গোল
জাতীয় দলে ক্যারিয়ার
* ১৯৭৬-৮৭ : ফ্রান্স ৭২ ম্যাচে ৪১ গোল
প্লাতিনির পরবর্তী ফরাসি ফুটবল লেজেন্ড জিদানের একটা বক্তব্য শুনলে বোঝা যায় প্লাতিনি কতটা ছাপ রেখে গেছেন ফরাসি ফুটবলে।
“When I was a kid and played with my friends, I always chose to be Platini. I let my friends share the names of my other idols between themselves.”
শুভ জন্মদিন মিশেল। বিতর্ক হয়তো কালিমালিপ্ত করতে পারে তোমার জীবনকে কিন্তু মুছে ফেলতে পারবে না বিশ্ব ফুটবলে তোমার অবদান।