জহর মিদ্দা, বয়স ৩৯, পেশায় ধান চাষি। বাড়ি কন্টাই, পূর্ব মেদিনীপুর। ফনি, আম্ফানের আস্ফালনে ধান চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকে গেছে। একবার চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকলে অন্তত তিন বছর সেই জমিতে চাষ করে কোন লাভ হয় না। আর কোন উপায় নেই, মজুরি খাটতে হবে অন্যের জমিতে নয়ত ভাত জুটবে না।
স্বপন পাড়ুই, বয়স ৪৬, মীন ধরে দিনযাপন করেন। বাড়ি নেতিধোপানি, সুন্দরবন। শেষ দুতিন বছরে মীন ধরতে গিয়ে বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। হারিয়েছেন একাধিক সঙ্গিসাথিকে। বছর কুড়ি ধরে জঙ্গলে মীন ধরতে যাওয়া স্বপনবাবু বললেন আগে হয়ত বছরে একবার বাঘ দেখতাম কিন্তু এখন প্রতি বারেই বাঘের মুখোমুখি হতে হয়।
সুমিত মাইতি, বয়স ৫৯, ডায়মন্ড হারবারে এক হোটেলে রান্না করতেন। কোভিড পরবর্তী সময় জীবিকা হারিয়েছেন। এখন ত্রাণের ওপর ভরসা করে দিন গুজরান করেন।
বঙ্গোপসাগরের উপকুলের চরিত্র বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হলেও সমস্যা গুলো মোটামুটি একই রকম। নোনা জল চাষের জমিতে ঢুকে পড়ায় কৃষি মার খাচ্ছে। নোনা চাষের জমিতে কিছু কিছু জায়গায় জল আটকে দিয়ে হছে ভেনামি চিংড়ির চাষ। ইতিপূর্বে ভিতরকনিকা অঞ্চলে এই চিংড়ি চাষে সর্বস্ব হারিয়েছেন অগনিত মানুষ। ইদানিং কালে সেই একই ধরনের প্রবণতা পূর্ব মেদিনীপুরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
চরিত্র পালটেছে সুন্দরবনের। অত্যাধিক লবণাক্ত মাটি, সাইক্লোন এবং মানুষের নানাবিধ কার্যকলাপে মারা যাচ্ছে ম্যানগ্রোভ। শিকারের অভাবে বাঘের সাথে মীন-মধুর সন্ধানে থাকা মানুষের আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় দেখা হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত চরিত্র পালটেছে বাঘেরাও। চোখাচুখি হলে নিমেযে উধাও হয়ে যাওয়া বাঘেরা সরাসরি আক্রমন করছে এখন। বহুবছর ধরে মীন ধরতে যাওয়া জেলেরা বাঘেদের এই অস্বাভাবিক আচরণের কারন বুঝতে পারছেন না।
প্রাথমিক জীবিকার পথ বন্ধ হওয়ায় মুশকিলে পড়ছেন দিন আনি দিন খাই মানুষেরা। তাদের বিকল্প কোন অর্থ উপার্জনের পথ নেই বললেই চলে। কোভিড এবং লকডাউনের ফলে ট্যুরিজ্ম মার খেয়েছে সাংঘাতিক ভাবে। বছর খানেকের মধ্যে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এরসাথে আছে কাটা ডিজেলের চলা অগুন্তি নৌকা/লঞ্চ যা নদীর জল দুষিত করছে সাংঘাতিকভাবে। সাথে শুরু হয়েছে নৌকা এবং লঞ্চের আগে নেট লাগানো যা ছোট মাছের শিকার করে চলেছে প্রতিনিয়ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাইক্লোনের সংখ্যা বাড়ছে ধীরে ধীরে। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিচ্ছে পলি জমে নাব্যতা হ্রাস এবং প্লাস্টিক দূষণ।
সুন্দরবনের ৩০ ভাগেরও বেশি পরিবারের অন্তত একজন মানুষ কাজের সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের বিভিন্ন শহরে পাড়ি দিচ্ছেন। এই সংখ্যাটি ক্রমশ বাড়ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে সুন্দরবনের মানুষ যদি জীবিকার জন্যে সম্পূর্ণভাবে শহরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পাড়ে।