কলমে: সুমন্ত বাগ
যদি পৃথিবীর ১০০ জন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষকে প্রশ্ন করেন খেলারজগতে সেরা ইভেন্ট কি? নিশ্চিতভাবে ৭০% মানুষ উত্তর দেবেন ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপ। কারণ চারবছর ধরে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফিরে আসে এই “গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ”। আর প্রতিবার দিয়ে যায় এমন কিছু রূপকথার জন্ম যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকে। আমরা যারা ফুটবল ভালোবাসি তাদের প্রত্যেকের নিজের একটা দল থাকে। সেই দেশের মানুষ না হয়েও আমরা অনুভব করি সেই দেশের হৃদস্পদন। সেখান থেকেই এমন কতগুলো টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ তৈরি হয়ে যায় যা জীবনের শেষদিন অব্ধি সঙ্গে থেকে যায় আর সঞ্চারিত হতে থাকে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে। এমনই এক টিমের কোলাজ যা আমাদের ভারতীয়দের তো বটেই পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে জমা হয়ে আছে। শুধুমাত্র পাঁচ পাঁঁচবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য নয় সুন্দর ফুটবলের জন্য, পেলে-গ্যারিঞ্চা নামক দুই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের জন্য আর অবশ্যই সেই আবেগের জন্য যে আবেগ মানুষকে ভুলিয়ে দেয় সমস্ত ক্ষোভ, দুঃখ, গ্লানি। কারণ ব্রাজিলিয়ান ফুটবল মানে শুধুই রূপকথা, শুধুই বেঁচে থাকার আর্তি, শুধুই থেমে না থাকার বার্তা।
১৯৫৮, ৬২, ৭০, ৯৪, ২০০২ এই পাঁঁচবার চ্যম্পিয়ান হয়েছে ব্রাজিল। প্রতিটি ব্রাজিল টিমেই ছিল এমন কিছু স্কিলফুল প্লেয়ার যারা শুধুমাত্র কাপই জেতেননি, জিতেছিলেন মানুষের মনটাকেও। এখন যদি এই পাঁচটা টিমের মধ্যে সেরা টিম বাছতে হয় নিঃসন্দেহে ১৯৭০ এর ব্রাজিল টিমটি সবার উপরে থাকবে। কেন? আসুন দেখে নেওয়া যাক সেই ” সাম্বা” ফুটবলের কিছু ঝলক।
১৯৭০ এর বিশ্বকাপ পূর্বের কিছু ঘটনা
জোয়াও সালধানা হলেন ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের এমন একজন কোচ যিনি বোটাফোগোকে বিশ্বের দরবারে তুলে এনেছিলেন নিজের প্রখর ফুটবল বুদ্ধি দিয়ে। ৫৮, ৬২ পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন হবার পর ৬৬-তে ইউসেবিওর পর্তুগালের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় ব্রাজিল। অথচ তখন ব্রাজিলীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ চলছে। সাও পাওলো, স্যান্টোস, ফ্ল্যামেঙ্গো, বোটাফোগো, কোরিন্থিয়াসের ফুটবল মাঠ মাতিয়ে চলেছেন একের পর এক জাত শিল্পীরা। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন ১৯৬৯ সালে টিমের দায়িত্ব তুলে দেন সালধানার হাতে। একটিও ম্যাচ না হেরে বিশ্বকাপের মূল পর্বে উঠে আসে ব্রাজিল। কিন্তু সালধানাকে সরে যেতে হয়, কেন জানেন? সালধানার মনে হয় পেলে তাঁর চিন্তাভাবনার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। এমনকি তিনি বিশ্বকাপের টিমলিস্ট জমা দেন পেলেকে বাদ দিয়ে। রাতারাতি সালধনাকে সরিয়ে মারিও জাগালোকে নিযুক্ত করেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ইয়াও হ্যাভালাঞ্জ।
মারিও জাগালো ছিলেন ৬২-এর বিজয়ী টিমের সদস্য ও পেলের একদা সতীর্থ। তিনি এসেই পেলেকে কেন্দ্র করে ৪-২-৪ ছকে টিম সাজাতে শুরু করেন। জাগালোর টিমটি ছিল এইরকম।
গোলরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন ফেলিক্স। ব্রাজিলে কোনদিনই সেইরকম বিখ্যাত কোন গোলকিপার জন্মাননি। এর কারণ হিসাবে ব্রাজিলিয়ানরা বলেন, আমাদের ছেলেরা গোল বাঁচানোর থেকে গোল করাতেই বেশি আনন্দ পায়। চিরকালের মত ৭০ এর টিমেও ব্রাজিলের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা ছিল এই গোলকিপার।
ডিফেন্সে দুই স্টপার হলেন পিয়াজা আর ব্রিটো। দুই সাইডব্যাক এভারেল্ডো আর কার্লোস আলবার্তো টরেস। এঁদের মধ্যে কার্লোস আলবার্তো ছিলেন ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক।
মাঝমাঠের নেতৃত্ব ছিল দুর্দমনীয় গারসনের হাতে। আর তাঁর পাশে নাছোড় মনোভাবাপন্ন ক্লডোয়াল্ডো, যিনি শুধু ট্যাকেল করেই থেমে যেতেন না ফিরতি বলকে এগিয়ে দিতেন স্ট্রাইকিং ফোর্সের কাছে।
স্ট্রাইকিং ফোর্স, হ্যাঁ পৃথিবীর সমস্ত ডিফেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য এর থেকে ভালো আর কি স্ট্রাইকিং লাইন হতে পারে! একদম বাঁদিকে ছিলেন টোস্টাও। যিনি “হোয়াইট পেলে” নামে খ্যাত। মাঝে ঈশ্বরপ্রদত্ত স্কিলের অধিকারী কিং পেলে। আর ডানদিকে অসম্ভব গোলক্ষুধা নিয়ে জেয়ারজিনহো। আরও একজন ছিল এই টিমে যাকে সালধানা বেঞ্চে বসিয়ে রাখতেন। তাঁর নাম রবার্তো রিভেলিনো। ছোটখাটো চেহারার গোঁফওয়ালা এই ফুটবলারটিকে দেখে একজন সুখী মানুষ ব্যাতীত অন্যকিছুই মনে হত না। কিন্তু পায়ে বল পড়লে তাঁর আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসতো। এই রিভেলিনোই ছিলেন ইলাস্টিক ড্রিবলিং-এর আবিস্কর্তা। মূলত বাঁপায়ের প্লেয়ার ছিলেন। কিন্তু দুপায়েই ছিল গোলার মত শট। জাগালোর তুরুপের তাস ছিলেন এই রিভেলিনো। মাঝমাঠ আর স্ট্রাইকারের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাতে তাঁকে ব্যবহার করে দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন জাগালো।
১৯৭০, মেক্সিকো ওয়ার্ল্ডকাপ
মেক্সিকোতে সেবার প্রথম বিশ্বকাপের আসর বসে। যেকারণের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে একটা বিরাট কৌতুহল ছিল যে কিভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অত উচ্চতায় ভালো ফুটবল খেলা যায়! ব্রাজিল টিম প্র্যাক্টিস শুরু করে সেই উচ্চতার কথা মাথায় রেখে। কারণ জাগালো বুঝেছিলেন শুধু স্কিল নির্ভর ফুটবল খেলে ৭২০০ ফিট উচ্চতায় ইউরোপের টিমগুলোর সাথে লড়াই করা যাবে না। তাই স্কিল, ট্যাকটিসের সাথে তিনি জোর দিয়েছিলেন ফিজিক্যাল ফিটনেসের ওপরেও। যার ফলও মিলেছিল হাতে নাতে। গোটা টুর্নামেন্টে ব্রাজিল গোল করেছিল মোট ১৯টি আর গোল খেয়েছিল মাত্র ৭ টি।
ব্রাজিলের সাথে সেবার গ্রুপে ছিল কারেন্ট চ্যম্পিয়ান ইংল্যান্ড, সদ্য ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন চেকোশ্লোভাকিয়া আর নতুন ইউরোপীয় শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া রোমানিয়া। এককথায় গ্রুপ অফ ডেথ বলা চলে। কিন্তু সাম্বার ঝলকানিতে ছারখার হয়ে যায় ইউরোপীয়দের শরীরসর্বস্ব ফুটবল। ব্রাজিল গ্রুপ চ্যম্পিয়ান হয়েই নক আউটে পাড়ি দেয়।
চেকোশ্লোভাকিয়া বনাম ব্রাজিল
গ্রুপের প্রথম ম্যাচে চেকদের মুখোমুখি হয় সেলেকাওরা। যেকোন কারণেই হোক টিমটা প্রথমে ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। ম্যাচের এগারো মিনিটের মাথায় হঠাৎ বাঁদিক থেকে একটা ঝটতি আক্রমণে গোল খেয়ে যায় ব্রাজিল। এই এক ঝটকায় যেন গোটা টিমটা জেগে ওঠে। তারপর শুরু হয় সাম্বা ফুটবল। ২০ মিনিটে সমতা ফেরায় ব্রাজিল। ডি বক্সের কাছে পেলেকে অবৈধভাবে ফেলে দিলে ফ্রিকিক পায় সেলেকাওরা। রিভেলিনোর বাঁপায়ের মাটিঘেঁষা শট চেক গোলকিপার থামাতে ব্যর্থ হয়। পরের গোলটি করেন পেলে, ৫৯ মিনিটে। গারসনের ভাসানো বলটিকে চেস্টট্রাপ করে যখন বক্সে নামান তখন একজন ডিফেন্ডার গায়ে লেগে আছে। দেহের দোলায় তাকে ছিটকে দিয়ে আউট স্টেপে বলটা জালে জড়িয়ে দেন। এরপর তান্ডব শুরু করেন জেয়ারজিনহো। জেয়ারজিনহোর মধ্যে দুটো সত্তার মিলন ঘটেছিল। একটা ছিল পারফেক্ট উইঙ্গারের বডি সোয়ার্ভিং আর উইং ধরে দৌড়, আর অপরটি হল একজন দক্ষ স্ট্রাইকারের মত তীব্র গোলক্ষুধা। গোলের যেন গন্ধ পেতেন তিনি। ৬১ ও ৮৩ মিনিটে দুটো গোল করে ব্রাজিলের ৪-১ গোলে জয় নিশ্চিত করেন।
ইংল্যান্ড বনাম ব্রাজিল
১৯৬৬ এর চ্যম্পিয়ান ছিল ইংল্যান্ড। বিখ্যাত সব প্লেয়ারদের নিয়ে সেবার মেক্সিকো গিয়েছিলেন কোচ স্যার অ্যালফ র্যামসে। ববি মূর, ববি চার্ল্টন, গর্ডন ব্যাঙ্কস, জিওফ্রে হার্স্টরা প্রথমার্ধে কোনভাবেই নড়তে দেয়নি ব্রাজিলিয়ানদের। গোলমুখের সামনে ববি মূরের নেতৃত্বে এমন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে যে পেলেসহ গোটা ব্রাজিল টিম সেই আস্তরণে আটকে যায়। এই ম্যাচের একটা দারুণ মূহুর্ত ছিল। রিভেলিনোর থেকে বল পেয়ে জেয়ারজিনহো উইং ধরে দৌড় শুরু করেন। ততক্ষণে ক্রসের আসায় ইংল্যান্ডের বক্সে উঠে এসেছেন কিং পেলে। একদম টাচলাইনের কাছে বলটা নিয়ে গিয়ে জেয়ারজিনহো ক্রস করেন। বক্সে তখন তিনজন ডিফেন্ডার আর পেলে। বাকিটা গর্ডন ব্যাঙ্কসের জবানিতে শুনুন।
“জেয়ারজিনহো যখন সেন্টারটা করলো তখন আমি প্রথম পোস্টে। বেগতিক দেখে পিছোতে শুরু করলাম। আড়চোখে দেখে নিলাম বলটা অনেক উঁচুতে এবং কারোর পক্ষেই তা নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। হঠাৎ আমার চোখ পড়ল পেলের ওপর। সে সব পারে। আর কি আশ্চর্য, স্প্রিংয়ের মত শরীরটা বাড়িয়ে পেলে হেড নিল। বল পোস্ট ঘেঁষে নিচু হয়ে গোলে ঢুকছে তখন। আমি কোন ঝুঁকি নিইনি। শূন্যে উড়ে গিয়ে হাতের উল্টোদিক দিয়ে বলটা তুলে দিলাম ক্রসবারের উপর দিয়ে। হ্যাঁ, এটাই আমার জীবনের সেরা সেভ।” ম্যাচটি ১-০ তে জিতেছিল ব্রাজিল। ৫৯ মিনিট লেগেছিল ইংল্যান্ডের তৈরি প্রাচীর ভাঙতে। টোস্টাও-এর বাড়ানো বল নিজে গোলে না মেরে ডানদিকে আরো ফাঁকায় দাঁড়ানো জেয়ারজিনহোকে সাজিয়ে দেন কিং পেলে। জেয়ারজিনহো গোল করতে ভুল করেননি।
ব্রাজিল বনাম রোমানিয়া
এই ম্যাচে মাঝমাঠের দুই প্লেয়ারকে বিশ্রাম দেন জাগালো। গারসন ও রিভেলিনোকে ছাড়াই মাঠে নামে সেলেকাওরা। পেলে এই ম্যাচে দুটো গোল করেন। আর একটা গোল করেন জেয়ারজিনহো। ব্রাজিল ৩-২ গোলে ম্যাচটি জিতে যায়।
শেষ আটের লড়াই, ব্রাজিল বনাম পেরু
ব্রাজিলের শেষ আটের লড়াইটা শুধু পেরুর সাথে ছিল না, লড়াইটা ছিল আরেক ব্রাজিলিয়ানের মস্তিষ্কের সাথে। ডিডি ছিলেন সেই ওয়ার্ল্ডকাপে পেরু টিমের কোচ। ডিডি,পেলে আর জাগালো একসাথে ফুটবলই খেলেননি দেশকে দু দুটো ওয়ার্ল্ডকাপও এনে দিয়েছেন। তাই পেরুর সাথে ম্যাচটা মোটেই সহজ ছিলনা। কিন্তু খেলা শুরু হতে দেখা গেল অন্য অঙ্ক, বাঁদিক থেকে রিভেলিনো আর টোস্টাও-এর যুগলবন্দী নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে পেরুভিয়ানদের। ১১ মিনিটে রিভেলিনো দলকে এগিয়ে দেন। এইবার ঝলসে ওঠেন হোয়াইট পেলে। দুজন পেরুভিয়ানকে বডি ফেইন্টে ছিটকে এক দুরুহ কোণ থেকে নিজের প্রথম ও ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোল করেন ১৫ মিনিটে। ৫৯ মিনিটে আরও একটি গোল করেন টোস্টাও, এবার বল সাজিয়ে দেন কিং পেলে। পেরুভিয়ানরাও হাল ছেড়ে দেননি। ২৮ ও ৭০ মিনিটে তারা ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্স টপকে দুটো গোল করে যান। কিন্তু ৭৫ মিনিটে আবার সেই জেয়ারজিনহোর দৌড়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। গারসনের বাড়ানো থ্রু বল ধরে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে জয় এনে দেন এই রাইট উইঙ্গার।
ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে, সেমিফাইনাল
আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা ব্রাজিল শেষ চারের লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় উরুগুয়ের। লাতিন আমেরিকার এই টিমের বিরুদ্ধে ব্রাজিলিয়ানদের এক গভীর ক্ষত আছে। ১৯৫০ সালের ফাইনালে প্রায় একলাখ দর্শকের সামনে ২-১ গোলে হেরে যায় ব্রাজিল, যা ফুটবল ইতিহাসে “মারকানাজো” নামে খ্যাত। তাই সেমিফাইনালের আগে দর্শকদের বিপুল আর্তি ছিল সেলেকাওদের কাছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। এই ঘটনা একটু হলেও চাপে ফেলে দেয় ফুটবলারদের। খেলার শুরুতে ঠিকঠাক বাজছিল না সাম্বার ছন্দ। যার ফলস্বরূপ “লা সেলেস্তে” ( উরুগুয়ের ফুটবল টিমের নাম) -রা ১৯ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে যায় আর প্রথমার্ধের শেষ মিনিট অবধি লিড ধরে রাখে।উরুগুয়ের কোচ জুয়ান হোবার্গ একটা মাত্র চালে ব্রাজিলকে আটকে রেখেছিলেন। গোটা টুর্নামেন্টে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডদের বল সাপ্লাই করে যাওয়া গারসনের ঘাড়ের ওপর একজন প্লেয়ার তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান ফুটবল মানেই তো বেঁচে থাকার আর্তি, থেমে না যাওয়ার লড়াই। যখন সবাই ধরে নিয়েছে লিড নিয়েই হাফটাইমে মাঠ ছাড়বে উরুগুয়ে, ঠিক তখন মাঝমাঠে একটা বল ধরে নিয়ে দৌড় শুরু করেন ক্লডোয়াল্ডো। বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে লেফট উইংয়ে বলটা ঠেলে দেন টোস্টাওকে। সামনে থাকা দুজন উরুগুয়ের প্লেয়ারকে কাটিয়ে বলটি তিনি বক্সের ভিতরে পাস দেন ক্লডোয়াল্ডোকে। পাঁচজন প্লেয়ারের সামনে থেকে ডানপায়ের আউটস্টেপে বলটি জালে জড়িয়ে দেন ক্লডোয়াল্ডো, সেই টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন ব্রাজিলের পাঁচ নম্বর স্কোরার।
অনেকেই হয়ত জানেন না টোস্টাও ৭০ এর ওয়ার্ল্ডকাপের আগেই অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন মাত্র ২৬ বছর বয়সে। কারণ টুর্নামেন্ট শুরুর কিছুমাস আগে এক ভয়ংকর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মাথার পিছনে মারাত্মক চোট পান। ডাক্তার বলেছিলেন আবার চোট পেলে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবেন। তাই ব্রাজিলকে কোয়ালিফাই করিয়েও অবসরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মারিও জাগালো ও কার্লোস আলবার্তোর অনুরোধে তিনি আবার ফিরে আসেন অবসর ভেঙে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে উরুগুয়ে ভালো ডিফেন্স করা সত্ত্বেও আরো দুটো গোল করেন জেয়ারজিনহো আর রিভেলিনো। ৩-১ গোলে ম্যাচটি জিতে ব্রাজিল ফাইনালে চলে যায়।
স্বপ্ন পূরণের রাত, অমরত্বের ঠিকানা
ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হয় কাতানেচ্চিও সিস্টেমের। জিওসেন্টো ফেচেত্তির নেতৃত্বে ইতালি তখন সেই ফুটবল খেলছে যেখানে গোল করার জন্য বিপক্ষের স্ট্রাইকাররা মাথা খুঁড়ে মরছে। সামান্যতম ভুলের সুযোগ নিয়ে ডিফেন্স থেকে কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করছেন স্যান্দ্রো ম্যাজোলা আর জিয়ান্নি রিভেরা। সেই কাউন্টার অ্যাটাক পূর্ণতা পাচ্ছে লুইগি রিভা ও বনিনসেগার পা হয়ে গোলের মাধ্যমে। ফাইনালের আগে ইতালি গোল করেছিল ৯ টা আর গোল খেয়েছিল ৪ টে। তাই লড়াইটা ছিল ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকার, বিশ্বসেরা রক্ষণ বনাম বিশ্বসেরা আক্রমণের।
মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন মেক্সিকান ওয়েভ ওঠে ব্রাজিলের জন্য। কারণ ইতালির কাছেই মেক্সিকো হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায়। পরবর্তীতে এক ইন্টারভিউতে পেলে বলেছিলেন, ” আমি মাঠে নামার সময় সেদিন নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারিনি। গোটা স্টেডিয়ামে মেক্সিকান সমর্থকেরা ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে ব্রাজিল আর আমার নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছিল। আমি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম।”
খেলা শুরু হওয়ার পর দেখা গেল ইতালি এক অন্য ছকে খেলা শুরু করেছে। জোনাল মার্কিং করে যে এই ব্রাজিলকে আটকানো যাবে না তা ভালো করেই বুঝেছিলেন আজুরি কোচ। তাই তিনি ম্যান মার্কিং করে খেলা শুরু করেন। বার্গনিচ আর ফেচেত্তির ওপরে পেলেকে আটকানোর দায়িত্ব দেন। ম্যাজোলার ওপর ছিল রিভেলিনোকে আটকানোর দায়িত্ব। এতটাই ম্যান মার্কিংকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেদিন ইতালি কোচ ভালকারেগি, যে মাঝমাঠের নির্ভরশীল প্লেয়ার জিয়ান্নি রিভেরাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখেন। ১৭ মিনিট অবধি ব্রাজিলকে আটকে রাখে আজুরিরা। কিন্তু বালির বাঁধ দিয়ে কি আর নদীর গতিকে রোধ করা যায়! কারণ নদী তো অন্তঃসলিলা, সে তার নিজ মর্জিতে নিজ বেগে প্রবহমান। লেফট উইংয়ে টোস্টাও-এর থ্রোইন থেকে বলটা যখন রিসিভ করছেন রিভেলিনো তখন তাকে বাধা দিতে তার গায়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন একজন ইতালির প্লেয়ার। শরীরটিকে বাঁকিয়ে রিভেলিনো বাঁপায়ে বলটা বক্সে ফেলে দেন। বল শূন্যে থাকা অবস্থায় বার্গনিচকে টপকে হেডে গোল করে যান কিং পেলে। এটি ছিল ব্রাজিলের বিশ্বকাপে ১০০তম গোল।
ইতালিও ছাড়ার পাত্র নয়। ৩৭ মিনিটে ক্লডোয়াল্ডোর একটা ভুল ব্যাকপাস থেকে মাঝমাঠে বল পেয়ে যান বনিনসেগা। ঠান্ডা মাথায় কার্লোস আলবার্তো ও পিয়াজাকে কাটিয়ে গোল করে সমতা ফিরিয়ে আনেন। সাময়িকভাবে গোটা অ্যাজটেকা স্টেডিয়াম স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবল ছারখার করে দেয় আজুরিদের ডিফেন্স। কোনক্রমে ৬৫ মিনিট অবধি সমতা টিকিয়ে রাখে তারা। ৬৬ ও ৭১ মিনিটে যথাক্রমে গারসন ও জেয়ারজিনহো গোল করে ব্রাজিলকে ৩-১ এর লিড এনে দেয়। গোটা মাঠ যখন উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে ঠিক সেই সময় ১৯৭০ সালের ওয়ার্ল্ডকাপের সেরা মূহুর্তের সূচনা হয়। ৮৬ মিনিটে গারসন একটা ডিফেন্স ফিরতি বল পাস করেন ক্লডোয়াল্ডোকে। ক্লডোয়াল্ডো ৪ জন আজুরিকে কাটিয়ে বলটি পাস করেন লেফট উইংয়ে রিভেলিনো কে। রিভেলিনো সেটি থ্রু বাড়ান বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জেয়ারজিনহোকে। জেয়ারজিনহো বলটি ধরে দুজন প্লেয়ারকে কাটিয়ে ডি বক্সের সামনে পেলেকে ঠেলে দেন। পেলে যখন বলটি ধরেন তখন তিনি বক্সের দিকে মুখ করে আছেন আর তাঁর সামনে চারজন প্লেয়ার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পেলে বলটি নিয়ে সামনে না এগিয়ে ব্লাইন্ড সাইডে একটা থ্রু বাড়িয়ে থেমে যান। নীচে থেকে উঠে আসা কার্লোস আলবার্তো ডান পায়ের আউট স্টেপে বলটিকে জালে জড়িয়ে দেন।
এই গোল দেখে ধন্য ধন্য করে ওঠে গোটা মাঠ। কারণ পেলে বলটি ধরার পর একবারের জন্যও পিছন ফিরে দেখননি কেউ আসছে কি না! অথচ নিখুঁত সময়ের হিসাব করে এমন জায়গায় থ্রুটি বাড়ান যেখান থেকে কার্লোস আলবার্তো বলটি ঠিকঠাক শট মারতে পারেন। কারণ এতটাই দুরুহ কোণ থেকে শটটি নিয়েছিলেন আলবার্তো যে সামান্য সময় ও কোণের এদিক ওদিক হলে বলটি বাইরে যেত। ফুটবল ইতিহাসে এই গোল “প্রেসিডেন্টস গোল” নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
ছয় ম্যাচে সাত গোল করে টুর্ণামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন জেয়ারজিনহো। শুধু তাই নয় ওয়ার্ল্ডকাপের প্রতিটি ম্যাচে গোল করার এই রেকর্ড আজ পঞ্চাশ বছর পরেও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। তিনবার চ্যম্পিয়ান হবার জন্য জুলেরিমের সোনার পরীটি চিরতরে ঘরে নিয়ে যায় ব্রাজিল। মারিও জাগালো ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি প্লেয়ার ও কোচ হিসাবে ওয়ার্ল্ডকাপ জেতেন।
পেটের জন্য ফুটবল শুরু করা এগারো জন ব্রাজিলিয়ানের এই লড়াই ও স্কিলের ঝলকানি ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে। এই টিমের গল্প একটাই শিক্ষা দিয়ে যায়, অমরত্ব পাওয়া যায় না সেটাকে অর্জন করতে হয়।