বিন্দু বিন্দুতে সিন্ধু হয় তা শুনেছেন কিন্তু দেখেছেন কি? এই বিন্দু বিন্দু তে সিন্ধু হওয়ার উদাহরন বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন। বড় প্লাস্টিকের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য গত বিপদ সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত, কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণা নাজেহাল করে ছাড়ছে বিজ্ঞানীদের। তাদের মতে প্লাস্টিকের ছোট ভাই কালে কালে ছাড়িয়ে যাবে বড় ভাইকেও।
কি এই প্লাস্টিকানু?
কাকে বলে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকানু? নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকলেও মোটামুটি ৫ মিলিমিটারের নিচের আকারের প্লাস্টিকগুলিকে প্লাস্টিকানু বলা হয়। প্রাইমারি প্লাস্টিকানু হল সেই সব প্লাস্টিকের কণা যারা উৎপাদনের সময় থেকেই পাঁচ মিলিমিটারের তলায়। এদের উদাহরণ হল কাপড়ের প্লাস্টিক তন্তু এবং প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র প্যালেট। সেকেন্ডারি প্লাস্টিকানু আবার বড় প্লাস্টিকের সামগ্রী যেমন বোতল, মাছ ধরার জাল, ক্যারিব্যাগ ইত্যাদি থেকে দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক কারণে ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট। প্লাস্টিকানু নানান ভাবে পরিবেশে মিশে যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কাপড় কাচার ফলে প্লাস্টিকানু জলের সাথে নিকাশি নালার মাধ্যমে মিশে যায় পরিবেশে, আবার রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণের ফলে ও প্লাস্টিকানু তৈরি হয় এবং পরিবেশে মিশে যায়। যেকোন ধরনের প্রসাধন সামগ্রীতেও থাকে প্লাস্টিকানু।
প্লাস্টিকানু যখন আকাশে বাতাসে জলে খাবারে
দক্ষিণ ফ্রান্সের পাইরোনিস পর্বতমালায় পাঁচমাসের জন্য ঘাঁটি গেড়েছিলেন বৈজ্ঞানিক দিওনে এলেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪০০ মিটার ওপরে অবস্থিত এই নির্জন গবেষণাগারের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই। সেখানে ৩০০ ন্যানোমিটার ফাঁকের ছাকনি দিয়ে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করেন তারা। দীর্ঘ পাঁচমাসের বৃষ্টির জল পরীক্ষা করে প্রতি বর্গমিটার এলাকায় ৩০০ এরও বেশি প্লাস্টিকানুর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন তারা। জনমানব শূন্য এই জায়গায় কথা থেকে এলো এই প্লাস্টিক? এক বিশেষ বায়ুমণ্ডলীয় ট্রান্সপোর্ট মডেল ব্যবহার করে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে পাঁচশ কিলোমিটারেরও বেশি দূর থেকে বাতাসে ভাসমান অবস্থায় এই প্লাস্টিকানু এসে পড়েছে এই অঞ্চলে। সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা নেচারে এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তারা বলেন “বৃহৎ প্লাস্টিকের দূষণের প্রতিকার সম্ভব হলেও এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণার গতিপথ রুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব”।
নিউক্যাসেল উনিভার্সিটির করা আরেক সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে এক আশঙ্খাজনক তথ্য। মানুষের শরীরে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ গ্রাম প্লাস্টিকানু বিভিন্ন উপায়ে প্রবেশ করে। অর্থাৎ বছরে প্রায় আড়াইশো গ্রাম পরিমান প্লাস্টিক আমাদের অজান্তেই আমরা গ্রহণ করছি । নেদারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জাপান, ইংল্যান্ড সহ সাতটি দেশের মানুষের মল পরীক্ষা করে প্লাস্টিকানুর সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারতে বিক্রি হওয়া বহুজাতিক সংস্থার গুলির প্লাস্টিকে মোড়ানো বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে প্লাস্টিকানুর উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে।
বিপদমুক্ত নয় পানীয় জলও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নয়টি দেশের দুশোরও বেশি বোতলজাত পানীয় জলের মধ্যে প্লাস্টিকানুর অস্তিত্ব পেয়েছেন। প্রতি লিটার জলে তিনশোরও বেশি আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিপদমুক্ত নয় খাবার নুনও। মুম্বাই আই. আই.টি. এর পরিবেশ প্রযুক্তি বিভাগের দুই গবেষক বাজার চলতি নুনের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন প্লাস্টিকানুর অস্তিত্ব।
পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে প্লাস্টিকের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ষাট এবং সত্তরের দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু সামুদ্রিক জীব এবং পাখির পৌষ্টিকতন্ত্রে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা খুঁজে পেতে শুরু করেন। কিন্তু আশঙ্কাজনক কিছু না হওয়ায় বিজ্ঞানিরা আসন্ন বিপদকে চিহ্নিত করতে অক্ষম ছিলেন। টনক নড়লো যখন ২০০৪-২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ উনিভার্সিটির প্রফেসর রিচার্ড থমসন সামুদ্রিক জীবের ওপর প্লাস্টিকানুর প্রভাব পরীক্ষা করেন এবং এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক ফলাফল সারা পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করেন।
প্লাঙ্কটন বা আণুবীক্ষণিক জীবকে খায় জলজ পোকারা, জলজ পোকাকে খায় ছোট মাছ, ছোট মাছকে খায় বড় মাছ। প্লাস্টিকানুর আকার আয়তন তাদের খাবারের মতো হওয়ায় প্লাঙ্কটনরা তাদেরকেই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। জলজ পোকা ১০ টি প্লাকটন খেলে, ছোট মাছ ১০ টি জলজ পোকা খেলে আর বড় মাছ ১০ টি ছোট মাছ খেলে ১০০০ টি প্লাস্টিকানু জমা হয় বড় মাছের পেটে। আর সেই মাছ যখন আমরা খাই তখন প্লাস্টিকানু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।
মানুষের শরীরে প্লাস্টিকানু
কি ঘটে যখন প্লাস্টিকানু প্রবেশ করে মানুষের শরীরে? খাবারের মধ্যে দিয়ে প্লাস্টিকানু আমাদের পাকস্থলীতে ঢোকে। আকারের ওপর নির্ভর করে কিছু প্লাস্টিকানু ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র হয়ে আমাদের শরীর থেকে মলের সাথে বেরিয়ে যায়। বাকি অংশের কিছু ভাগ পাকস্থলী বা অন্ত্রের ভেতর জমা হতে থাকে এবং কিছু ভাগ রক্তে মিশে দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী আটটি দেশের অসংখ্য মানুষের মলে প্লাস্টিকানুর উপস্থিতি প্রমান করেছেন। একই রকম ভাবে ইংল্যান্ডের একদম বিজ্ঞানী প্রস্রাবের মধ্যে পেয়েছেন এই সব আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের কণা।
সম্প্রতি ভেলোর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর এবং তার সহকর্মীরা এক সাংঘাতিক পর্যবেক্ষণের কথা জানান। তারা দেখেন যে প্লাস্টিকানু রক্তে প্রবেশের পর রক্তের বিভিন্ন প্রোটিনের সাথে মিশে প্লাস্টিকানু-প্রোটিন কমপ্লেক্স তৈরি করছে। আকারে অপেক্ষাকৃত বড় এই কমপ্লেক্স গুলি একে অপরের সাথে জুড়ে গিয়ে শিরা এবং ধমনীর মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। গোদের ওপর বিষফোড়া হিসেবে এই অতিকায় কমপ্লেক্সগুলি লোহিত রক্ত কণিকা এবং শ্বেত রক্ত কণিকা গুলিকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলছে। ফলস্বরূপ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা, রক্ত তঞ্চন ক্ষমতা এবং অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও প্লাস্টিকানু শরীরে প্রবেশ করে মানুষের খাদ্যাভাসের ইচ্ছে কমিয়ে দেয়, হরমোনের নিঃসরণ প্রতিরোধ করে, বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, জনন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায় এমনকি স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে।
শেষের কথা
সমস্যার কথা তো হল অনেক, কিন্তু সমাধান কি নেই একেবারেই? সমাধানের পথটি বড়ই দুর্গম। খাবার জলের থেকে প্লাস্টিকানু আলাদা করার জন্য শুধু মাত্র রিভার্স অসমসিস যথেষ্ট না, আলট্রা বা ন্যানো ফিলট্রেশনের দরকার আছে, এমন ই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু জল ছাড়াও এই ভয়ানক বিপদকে আটকাবেন কি করে? বাতাসে, লবনে, খাবারে, মাজনে, সাবানে এমনকি মুখে মাখার ক্রিমেও মিশে আছে প্লাস্টিকানু। কাজেই প্লাস্টিকের ব্যবহার কম না করলে প্লাস্টিকানু শরীরে প্রবেশ করবেই। প্লাস্টিকের জল খাওয়ার বোতলটা পাল্টে স্টিলের বোতল বা প্লাস্টিকের প্লেট বদলে শাল পাতার থালা ব্যবহার করে দেখুনই না। শরীরময় জমতে থাকা প্লাস্টিকের পরিমান কমবেই।
সমুদ্রে প্লাস্টিকানুর নির্মূল করা অতন্ত্য কষ্টকর ব্যাপার। প্লাস্টিকানু আকারে এতটাই ছোট যে সমুদ্রে মিশে থাকা বিপুল পরিমান প্লাস্টিকানুকে ফিল্টার করে আলাদা করতে গেলে প্লাস্টিকানুর সাথে সামুদ্রিক অণুজীব তথা শৈবাল, প্লাঙ্কটন ইত্যাদির মিশে চলে আসবে। এতে ভেঙে পড়বে পুরো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। আসার আলো দেখাচ্ছে স্লোভেনিয়ার বিজ্ঞানীরা। জেলিফিসের মিউকাস থেকে চটচটে এক তরল তারা ল্যাবরেটরিতে বানিয়েছেন যা কিনা প্লাস্টিকানুদের ধরে আবদ্ধ করে রাখতে সক্ষম। জেলিফিসের মিউকাসের এই ধর্ম প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল দূষিত জল থেকে ভারী ধাতুর ক্ষুদ্র কণাদের পৃথক করতে। বর্তমানে পরীক্ষামূলক ভাবে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের জলে এই মিউকাসকে পরীক্ষা করছেন। আর সেই ফলাফলের দিকেই চেয়ে আছে সারা পৃথিবীর মানুষ।