কলমে : সুমন্ত বাগ
ওয়াসিম আক্রম : সুলতান অফ সুইং
১৯৪৭-এর দেশভাগ ও তার পরবর্তী ঘটনানুক্রম আমাদের মনে এমন এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে যে “পাকিস্তান” নামটা শুনলেই মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়, কারণ দু’দেশের শত্রুতার ইতিহাসটাও জি.টি রোডের মতো লম্বা। তবু এই শত্রুতার মধ্যেও এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের নাম বা উপস্থিতির কাছে এসব ব্যবধান তুচ্ছ হয়ে এক অনন্যশ্রদ্ধায় মাথা নীচু হয়ে আসে। আজকের লেখায় বলব তেমনই একজনের কথা যিনি তাঁর পারফরমেন্স দিয়ে আমাদের শত শত দেশবাসীর হৃদয় ভেঙে খান খান করেও আমাদের মনে নিজের আসন পাকা করে রেখেছেন, আক্ষরিক অর্থেই তিনি কর্মযোগী। আর আমরা সবাই জানি যে, পারফর্মারদের কোন দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি থাকতে নেই, কেবল থাকতে আছে কোটি কোটি মানুষের মনে একটা থাকার জায়গা।
আবির্ভাব ~
সেটা ১৯৮৪ সাল। পেসারদের তুলে আনার জন্য পাকিস্তানের অনেক জায়গাতেই ক্যাম্পের আয়োজন করা হত। তেমনই একটা ক্যাম্প চলছিল লাহোরে। সেই ক্যাম্পে জমা পড়েছিল নয় নয় করেও প্রায় ২০০ জনের নাম। লাহোরের সেই ক্যাম্পে হাজির ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান দলের এক প্রধান স্তম্ভ জাভেদ মিঁয়াদাদ এবং নির্বাচক হাবিব আসান। প্রথম দু’দিন কিছু ছেলেকে ভালো লাগলেও ঠিক মনঃপুত হয়নি মিঁয়াদাদের। তিন নম্বর অর্থাৎ শেষ দিনের ক্যাম্পেরও প্রায় শেষ লগ্ন আর মাত্র ২৫ জনের মত ছেলের বোলিং বাকি আছে। মিয়াদাঁদ আর হাবিব ভাবছেন আর বোধহয় তেমন একটা ভালো একটা পেসার খুঁজে পাওয়া যাবে না। সময় এগোচ্ছে ঘড়ির কাঁটার নিয়ম মেনে, ঠিক এমন সময়ে লিকলিকে রোগা ঝাঁকড়া চুলের এক কিশোর বল নিয়ে দৌড় শুরু করলেন। প্রথম বলটা করার পরই কিঞ্চিৎ হালছেড়ে দেওয়া মিঁয়াদাদ একটু যেন নড়েচড়ে বসলেন, বাঁহাতি এই ছেলেটার গতিতো বেশ, তারপর লাইন আর নাগাড়ে একই লেন্থে বল ফেলার ক্ষমতা দেখে মিঁয়াদাদ অবাক আবার খানিকটা উল্লসিতও, সঙ্গে থাকা জাতীয় নির্বাচক হাবিব আসানকে জানালেন আগামী নিউজিল্যান্ড সফরে এই ছেলেকেই তাঁর চাই।
হাবিব এই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যা তথ্য পেলেন তাতে আর যাই হোক একে জাতীয় দলে এখনই পাঠানো চলেনা। এ ছেলের নাম ওয়াসিম আক্রাম চৌধুরী, লাহোরের “পাকিস্তান অটোমোবাইল কর্পোরেশন” নামের এক ক্লাবের হয়ে খেলে। কোনো ডিস্ট্রিক্ট বা ডিভিশন খেলার অভিজ্ঞতা এর নেই। এমন আনকোরা অনভিজ্ঞ ছেলেকে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলে রাখা চলে? হাবিব একথা মিঁয়াদাদকে জানান, কিন্তু মিঁয়াদাদ নাছোড়বান্দা। আগামী নিউজিল্যান্ড সফরে ওই ছেলেকেই তাঁর চাই। সেসময় ইমরান একটা অস্ত্রোপচার করানোর জন্য অস্ট্রেলিয়ায়, সুতরাং আগামী নিউজিল্যান্ড সফরের ক্যাপ্টেন মিঁয়াদাদ, অগত্যা তাঁর জেদের কাছে পাকিস্তান বোর্ডকে নতিস্বীকার করতেই হল।
ফিনিক্স পাখি~
৮৪-র পাকিস্তান অটোমোবাইলের সেই ছেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তখন পরিচিত নাম। বসন্তের পাতার মতোই চৌধুরী ঝরে গিয়ে ১৯৯২-এর বিশ্ব তাকে চেনে ওয়াসিম আক্রাম নামে। সে বছর পাকিস্তান গ্রুপ পর্যায়ে চারটি ম্যাচ হেরে এবং সেমিফাইনালে ইনজির অতিমানবিক ইনিংসের দৌলতে কোনক্রমে ফাইনালে উঠে পড়ে। বিপক্ষ টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট টিম ইংল্যান্ড। আর এই ইংরেজদের কাছে গ্রুপ পর্যায়ে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়ে লজ্জার সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই দলটাই। টসের আগে ইমরান তাঁর সহখেলুড়েদের কী বলেছিলেন আমরা জানিনা কেবল জানি ফাইনালে টসে জিতে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থতা যেন পিছু ছাড়ছিল পাকিস্তানের, ডেরেক প্রিঙ্গেলের বিষাক্ত সুইং সামলাতে না পেরে মাত্র ৮ ওভারেই পাকিস্তানের স্কোর দুই উইকেট হারিয়ে মাত্র চব্বিশ। আর ঠিক তখনই ব্যাট হাতে পাকিস্তানের ধ্বস আটকান বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ দুই সৈনিক ইমরান আর মিঁয়াদাদ। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৃতীয় উইকেটে ১৩৯ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ওঠে যা কিছুটা অক্সিজেন দেয় পাকিস্তানকে। কিন্তু সুখ যেন স্থায়ী হয়না। ৪০ ওভারে আবার ছন্দপতন। দলের ১৬৩ রানের মাথায় মিঁয়াদাদ আউট। ক্রিজে এলেন সেমিফাইনালের বিশালবপু ইনজি। ইনিজিকে ননস্ট্রাইকিং এন্ডে রেখে হাত খুললেন ইমরান। ভাবখানা যেন ওহে আমি চলে গেলে তুমিও চালিয়ে নিয়ে যেও। ভাবনা সত্যি করে ৪৪ ওভারের মাথায় ইলিংওয়ার্থের হাতে ক্যাচ দিয়ে খান সাহেব যখন ফিরে যাচ্ছেন, স্কোরবোর্ডে বলছে পাকিস্তান তখন ৪-১৯৭।
এরপর অধিনায়ক ইমরানের আরেকটা মাস্টারস্ট্রোক । ইজাজ আহমেদ, সেলিম মালিক, মঈন খানের মতো ব্যাটসম্যানদের বসিয়ে রেখে ব্যাট করতে পাঠালেন বিশ্বস্ত সেনানী আক্রামকে। আর এই চালেই যেন ইংরেজদের সব হিসাব ওলট-পালট হয়ে গেল। খেলেন ১৮ বলে ৩৩ রানের একটা ছোট্ট ইনিংস উপহার দিয়ে গেলেন ৮৪-র সেই ওয়াসিম আক্রাম চৌধুরী। আক্রাম আর ইনজির (৩৩ বলে ৫৩ রান) পার্টনারশিপের সৌজন্যে পাকিস্তান ইনিংস শেষ করলো ২৪৯ রানে।
বিরতির পর ইংল্যান্ডের ইনিংস শুরু করলেন গ্রাহাম গুচ আর স্যার ইয়ান বোথাম। কিন্তু শূন্য রানে বোথামকে ফিরিয়ে ধাক্কাটা প্রথম দিলেন সেই আক্রাম। আর তারপর পাকিস্তানি বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের জন্য একটা সময় মাত্র ৬৯ রানে ৪ উইকেট চলে যায় ইংল্যান্ডের। তবে কি ইন্দ্রপতন! কিন্তু না ক্রিকেট ভয়ঙ্কর অনিশ্চিতের খেলা আর সেই আপ্তবাক্য মেনেই যেন এখান থেকে ম্যাচটা ধরে নিলেন–নিল ফ্রেয়ারব্রাদার আর অ্যালান ল্যাম্ব। ৭২ রান যোগ করে দু’জনে ধীরে ধীরে বেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ইংল্যান্ডকে। কিন্তু আবার অধিনায়ক ইমরান বল তুলে দিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনানির হাতে। আক্রামের হাত দিয়ে বেরিয়ে এবার বেরিয়ে এলো দুটো স্বপ্নের ডেলিভারি। যে অফকাটারে তিনি ল্যাম্বের উইকেট ছিটকে দিয়েছিলেন সেটাকে এখনো পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডকাপের সেরা ডেলিভারি বলেই ধরা হয়। আর তার ঠিক পরের বলে শৈল্পিক ইনসুইংয়ে বোল্ড ক্রিস লুইস। এই ধাক্কা সে যাত্রায় ইংরেজরা আর সামলাতে পারেনি, ফলাফল ইনিংস শেষ ২২৭ রানে। ৩৩ রান ও ৪৯ রানে ৩ উইকেটের সুবাদে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ওয়াসিম আক্রাম। পেস ক্যাম্পের ডিস্ট্রিক্ট বা ডিভিশন না খেলা ঝাঁকড়া চুলের কিশোরের হাত ধরে পাকিস্তানের হাতে ওঠে তাদের প্রথম বিশ্বকাপ।
এক যোদ্ধা ও তাঁর বাঁক খাওয়া বল~
ডায়াবেটিস এমন এক রোগ যা ধীরে ধীরে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। গোটা বিশ্বের কাছেই এ এক মারণ রোগ। কিন্তু একটা লোক সেই টাইপ-1 ডায়াবেটিস নিয়েও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেললেন ৭ বছর! ভাবা যায়? ১৯৯৬ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে আক্রামের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। অনেকেই ভেবেছিলেন শেষ হয়ে গেল বুঝি ম্যাজিক ল্যাম্প, কিন্তু তিনি ওয়াসিম আক্রাম–শুধু মাঠের মধ্যেই নয় জীবনের ২৪টা বছর ধরে টাইপ-1 ডায়াবেটিসকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। কী করে পারলেন? নিয়ন্ত্রিত বোলার বলেই কি? এটা যে ঠিক কতবড় একটা প্রাপ্তি তা যারা ডায়াবেটিস রোগী বা এ রোগ সম্পর্কে খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন। আসলে আক্রাম মানেই তো মিরাক্যাল, তা না-হলে একজন ফাস্ট বোলারের কেরিয়ার ১৮ বছর দীর্ঘ হয়? একজন ফাস্ট বোলার তাঁর গোটা কেরিয়ারে টেস্টে ১৭ বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ(১০২টা টেস্টে) আর ৭ বার ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছে কেউ কল্পনা করতে পারবেন? মনে হয় না।
একজন বোলার গোটা কেরিয়ারে একটা হ্যাট্রিক করতে পারলেই যেখানে ধন্য হয়ে যান সেখানে চার চারটে ইন্টারন্যাশনাল হ্যাট্রিকের মালিক ওয়াসিম আক্রাম (২টি টেস্টে আর ২ টি ওয়ানডেতে)। রিকি পন্টিংকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার জীবনে খেলা শ্রেষ্ঠ বোলার কে? উত্তরে পন্টিং বলেন, “অ্যামব্রোজ আর আক্রাম হল আমার জীবনে খেলা সেরা দুই ফাস্ট বোলার। উল্টোদিকে যখন আক্রাম থাকবে আপনি কিন্তু বেশ কিছু রান তার বিরুদ্ধে পেয়ে যাবেন। তারপর এমন একটি আনপ্লেয়েবেল বল আসবে যখন আর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোন পথ থাকবে না, সেটা নতুন বলেও হতে পারে কিংবা পুরনো বল।”
শাসন! হ্যাঁ একে শাসনই বলা চলে। ১৮ বছর ধরে ক্রিকেট দুনিয়াকে নিজের সিম আর সুইং দিয়ে শাসন করেছেন আক্রাম। শুরুর দিকের দিনগুলোতে বেশ ভালো গতিতে বল ছাড়তেন। কিন্তু ওয়াকার ইউনিস, আকিব জাভেদ টিমে এসে যাওয়ার পর নিজেকে কিছুটা পাল্টে নেন তিনি। লাইন লেন্থে কন্ট্রোল তো আগে থেকেই ছিল এবার যুক্ত হয় ভ্যারিয়েশন। একইরকম বোলিং অ্যাকশনে শুধু আঙুলের কারিকুরিতে ছটা ছ’রকম বল করতে পারতেন এই আক্রম। ব্যাটসম্যানের পক্ষে দুরুহ ব্যাপার ছিল এটা বোঝা কোনটা ভিতরে আসবে আর কোনটা বাইরে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রিভার্সসুইং। আর রিভার্সসুইংকে তো তিনি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্মৃতিকাতুরেরা এমন অনেক ম্যাচ মনে করতে পারবেন যেখানে পাটা উইকেটে শুরুর দিকে মার খেয়েও ৩০ওভারে বল একটু পুরনো হতেই বলকে দিয়ে যেন কথা বলিয়েছেন আক্রম। ১০২টি টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৪১৪টি উইকেট আর ৩৫৬টি ওয়ানডেতে ৫০২টি উইকেট। তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বোলার যিনি ওয়ানডেতে ৫০০ উইকেটের মালিক হয়েছিলেন। পরে যদিও মুরালিধরন সেই রেকর্ড ভেঙে দেন।
সেনাপতির বিশ্বস্ত সেনানি ও তাঁর তলোয়ার~
ইমরান খানের সাথে ওয়াসিম আক্রামের সখ্য ছিল দেখবার মত, সেটা মাঠের ভিতরে হোক বা বাইরে। যতই মিঁয়াদাদ তাঁকে আবিষ্কার করুন বা প্রথম টেস্ট ক্যাপ্টেন হোন না কেন, আক্রম কিন্তু ক্যাপ্টেন বলে চিরকাল মেনে এসেছেন ইমরানকেই। আক্রাম সবসময় বলে এসেছেন, যে আগ্রাসন নিয়ে তিনি ক্রিকেটটা খেলেছেন সেটা ইমরানের থেকে পাওয়া। আর ইমরানও মাঠের মধ্যে যখনই বিপদে পড়তেন তখনই এগিয়ে দিতেন আক্রামকে। এ যেন এক অনন্য বোঝাপড়া। আর আক্রামও বেশিরভাগ সময়ই তাঁর ক্যাপ্টেনের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন। তবে আক্রামকে নিয়ে একটাই আফসোস উজির-এ- আজম- এর, তিনি বারবার বলতেন, আক্রাম যদি একটু নিজের ব্যাটিং নিয়ে সিরিয়াস হতো তাহলে হয়তো উপমহাদেশের সেরা অলরাউন্ডার হয়ে উঠত। আর বলবেন নাই বা কেন! এমন অনেক ম্যাচ আছে যেখানে আক্রাম লোয়ার মিডলঅর্ডারে ব্যাটিং করে পাকিস্তানকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিয়েছেন। ছটা পঞ্চাশসহ প্রায় চারহাজার রান রয়েছে তাঁর ও-ডি-আই ঝুলিতে। টেস্টে রয়েছে তিনটি শতরান আর সাতটি অর্ধশতরান সহ মোট প্রায় তিনহাজার রান। আবার টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরির একটি ডাবল, যা কিনা শুধুই ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর নয়, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৮ নম্বরে ব্যাট করা কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর, ২৫৭ নট আউট।
আজ সেই ঝাঁকড়া চুলের সেই ছেলেটার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন সুলতান। তোমার সুইং আর কাটারগুলো তোমার মতই পারফেক্ট জেন্টলম্যান। তোমার হাত থেকে বেরোনোর পর যারা ভদ্রভাবে নিজের কাজ করে গেছে ১৮ বছর ধরে। তোমারই মত কলঙ্কবিহীন থেকে গেছে চিরকাল। যাদের কোন ব্যাটসম্যানের স্কিল ছুঁতে পারেনি।