সমুদ্র, ক্রিকেট আর সদাহাস্যময় কিছু কালো মানুষের ভিড়, এই ছবির মধ্যে ভেসে ওঠে একটাই দেশের নাম, সেটা হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখানে অভাব আছে, দারিদ্র্যতা আছে, আছে বুভুক্ষু মানুষও কিন্তু হাসিটা কখনোই মিলিয়ে যায় না মানুষের মুখ থেকে। আর তারা বাঁচার রসদ খুঁজে নেয় ক্রিকেট নামক একটা খেলা থেকে। ওদের কাছে ক্রিকেট হল মুক্তি, ক্রিকেট মানে আনন্দ। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট কখনোই প্রতিপক্ষের আনন্দের কারণ হয়ে ওঠেনি। ব্যাটিং হোক কি বোলিং, সর্বদা প্রতিপক্ষের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দেওয়াই হল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মূলকথা। স্পোর্টসম্যানশিপ আর আগ্রাসী ক্রিকেটের এক অদ্ভুত মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেছে ক্যারিবিয়ানরা। চার্লি গ্রিফিথের বাউন্সার মাঠের মধ্যে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন নরি কন্ট্রাক্টরের, আবার ফ্রাঙ্ক ওরেলের রক্তে জীবনদান পেয়েছেন কন্ট্রাক্টর সাহেব। এইরকম প্রচুর ঘটনা আছে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট ইতিহাসে। ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দিয়ে তারা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন বারবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কালো মানুষদের অধিকার রক্ষায় যখন উত্তাল হয়ে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তখন নিঃশব্দে ক্রিকেট মাঠে পা রাখেন তিনজন সদ্য একুশ পেরোনো যুবক। বার্বাডোসের অধিবাসী ছিলেন তিনজনই। তখন জর্জ হ্যাডলির ব্যাটিংয়ে মোহিত ক্যারিবিয়ান তথা বিশ্বক্রিকেট। ৬৬.৬৪ ব্যাটিং গড় নিয়ে একটা মানুষ এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ মহাযুদ্ধের জন্য ছেদ পড়ে তাঁর অগ্রগতিতে। যুদ্ধপরবর্তী আবার যখন ক্রিকেট শুরু হয় তখন ক্যারিবিয়ানরা বিশ্বক্রিকেটকে উপহার দেয় তিন ভয়ংকর ব্যাটসম্যান। ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভার্টন উইকস আর ক্লাইড ওয়ালকট, ক্রিকেট দুনিয়ায় যারা “থ্রি ডাব্লিউ” নামে বিখ্যাত হয়। সম্ভবতঃ ইতিহাসের সর্বকালের সেরা তিন মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন এই “থ্রি ডাব্লিউ”। তিন নম্বরে ব্যাট করতেন ওয়ালকট, চারে উইকস আরে পাঁচে আসতেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ রাজত্ব করেছেন এই বিশ্ব ক্রিকেটের “থ্রি ডাব্লিউ”। এই সময় ক্যারিবিয়ানদের মিডল অর্ডারের ব্যাটিং গড় ছিল ৪৭.৯৯ আর তারপরেই ছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং গড় ৩৯.১৫।
স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলঃ শিষ্টাচারের অপর নাম
১৯৪৮ এর যে টেস্টে বাকি দুই ডাব্লিউয়ের অভিষেক হয় সেই টেস্টে কিন্তু অভিষেক হয়নি ওরেলের। পরের টেস্টে তিনি টিমে আসেন আর তারপর ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। “থ্রি ডাব্লিউ”এর একমাত্র অলরাউন্ডার ছিলেন স্যার ওরেল। ডানহাতে ব্যাট করতেন আর কখনো বাঁহাতি মিডিয়াম পেস অথবা স্লো অর্থোডক্স বোলিং করতেন। ৫১টি টেস্ট খেলে ৪৯.৪৮ গড়ে ৩৮৬০ রান করেন আর ৬৯টি উইকেট নেন। গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি ৯টা সেঞ্চুরি আর ২২টি হাফ সেঞ্চুরি করেন। সর্বোচ্চ রান ছিল ১৯৫০ সালে ট্রেন্টব্রিজে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা ২৬১ রান। একমাত্র ব্রাডম্যান আর জর্জ হেডলি ছাড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই দাপট তার আগে কেউ সেভাবে দেখাতে পারেননি। ওয়ালকট আর উইকসের তান্ডবে যখন প্রতিপক্ষ বোলাররা ক্লান্ত হয়ে যেত তখন ক্রিজে আসতেন ওরেল। তারপর শুরু করতেন ঠান্ডা মাথায় ইনিংস গুছোনোর কাজ। ওরেলের কোন শত্রু ছিল না বরং বলা ভালো তিনি সবার বন্ধু ছিলেন। ১৯৬০ সালে প্রথম ক্যাপ্টেন হন এই মহান ক্রিকেটার, তিনিই ছিলেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্যাপ্টেন। এরপর শুরু হয় ক্যাপ্টেন ওরেলের স্বপ্নের সফর। ১৯৬০-৬১ অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল তাঁর ক্যাপ্টেন হিসাবে প্রথম সফর এবং এই সফরের পুরস্কারের ট্রফিটি ছিল তাঁর নামাঙ্কিত ট্রফি, ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি। যদিও সেই সফরের ফল ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে যায়। অস্ট্রেলিয়া ২-১-এ সিরিজ জিতে প্রথমবারের জন্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফি জিতে নেয়। তবে এই সিরিজের বিশেষত্ব ছিল দুই ধুরন্ধর ক্যাপ্টেনের দল পরিচালনার কলা কৌশল। অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনো ও ফ্রাঙ্ক ওরেল দুজনেই খুব প্রশংসা পান আগ্রাসী ক্রিকেট খেলার জন্য।
এরপর সেই বিখ্যাত ভারত সফর যেখানে ওরেলের রক্তে জীবন বাঁচে ভারতীয় ক্রিকেটার নরি কন্ট্রাক্টরের এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতে ৩-১-এ। জীবনের শেষ টেস্ট সিরিজ ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬৩ সালে। চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েলেসলি হলের আগুনে বোলিং, গ্যারি সোবার্সের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য ইংরেজরা ঘরের মাঠে সিরিজ হারে ৩-১ -এ। দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন্সি করে ইংরেজদের মন জিতে নেন ফ্রাঙ্ক ওরেল। ১৯৬৬ সালে ভারত সফরে আসেন টিমের ম্যানেজার হয়ে এবং জানতে পারেন তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। দেশে ফিরে চিকিৎসা শুরু করলেও আর বেশিদিন বাঁচেননি স্যার ওরেল। ১৯৬৭ সালের ১৩ই মার্চ তাঁর অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে ইহলোককে বিদায় জানান এই মহান ক্রিকেটার।
স্যার ক্লাইড ওয়ালকট
“থ্রি ডাব্লিউ”এর সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন স্যার ক্লাইড ওয়ালকট। তিন নম্বরে ব্যাট করতে এসে তুলোধোনা করে দিতেন বিপক্ষের বোলারদের। স্যার ওয়ালকট প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন যারফলে খুব সহজেই কাট, পুল ও হুক করতে পারতেন। এতো জোরে ব্যাকফুটে ড্রাইভ করতেন যা অনেক ব্যাটসম্যান ফ্রন্টফুটেও খেলতে পারতো না। ১৯৫০ এর ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর খেলা ১৬৮ নট আউটের ইনিংসটাই দুই টিমের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। ৩২৬ রানের বিশাল জয় ছিনিয়ে আনে ক্যারিবিয়ানরা। গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাত্র একবারই শূন্য রানে আউট হয়ে ছিলেন স্যার ওয়ালকট, ১৯৫১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। ১৯৫৫ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া ক্যারিবিয়ান সফরে যায় তখন একাই তাদের বিরুদ্ধে ১০ ইনিংসে ৮২৭ রান করেন। কিন্তু সিরিজ হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্যার ওয়ালকট ৪৪ টেস্টে ৫৬.৬৮ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩,৭৯৮ রান। যার মধ্যে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ১৫টি এবং হাফসেঞ্চুরি ১৪টি। ৪৪ টেস্টের মধ্যে ২২টি টেস্টে ব্যাট করেছেন ৫ নম্বর ব্যাটিং পজিশনে, সেখানে ৫৯.২২ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১,৫৯৯ রান। উইকেটকিপারের দায়িত্ব ছাড়ার পর পার্টটাইম বোলিং শুরু করেন তিনি। মিডিয়াম পেস বল করে উইকেট নিয়েছেন ১১টি।
ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটেও একই দাপটের সাথে খেলেছেন স্যার ওয়ালকট। ১৪৬টি ম্যাচে ৫৬.৫৪ গড়ে রান করেছেন ১১৮২০, যার মধ্যে ছিল ৪০টি সেঞ্চুরি ও ৫৪টি হাফ সেঞ্চুরি। ১৯৬০ সালে ইংল্যান্ড সিরিজের পর আর কোনদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে মাঠে নামেননি স্যার ক্লাইড ওয়ালকট। ক্রিকেট বোর্ডের সাথে কোন একটা ঝামেলায় নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। ২০০৬ সালে ২৬শে আগস্ট “থ্রি ডাব্লিউ”-এর একমাত্র প্রতিনিধি এভার্টন উইকসকে রেখে অমৃতলোকে পাড়ি দেন স্যার ওয়ালকট।
স্যার এভার্টন উইকস
অনেক ক্রিকেট পন্ডিতের মতে “থ্রি ডাব্লিউ”-এর সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান ছিলেন স্যার এভার্টন উইকস। মাত্র বারো ইনিংসে পূর্ণ করেছিলেন ১০০০ রান আর গোটা ক্যারিয়ারে ৪৮টি টেস্টে ৫৮.৬১ গড়ে ৪৪৬৫ রান, অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে। এখানেই শেষ নয় আরো আছে! এমন একটা রেকর্ডের অধিকারী তিনি যা আজ ৭২ বছর ধরে অক্ষত আছে, সেটা হল ৪টি টেস্ট ম্যাচে পর পর পাঁচটি ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড। যার মধ্যে শেষ ইনিংসটা ছিল কোলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে খেলা তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ইনিংস। ওই ম্যাচে শুঁটে ব্যানার্জির সুইংয়ে যখন নাকানিচোবানি খাচ্ছে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং তখন স্যার উইকসের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসে ১৬২ রানের এক ঝকঝকে ইনিংস। মাত্র তিন ঘন্টা ক্রিজে থেকে ২৪টি বাউন্ডারির সাহায্যে এই ইনিংস খেলেন তিনি। গোটা ক্যারিয়ারে তিনি বন্ধু ওয়ালকটের মতই ১৫টি সেঞ্চুরি করেন আর হাফ সেঞ্চুরি করেন ১৯টি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেরা ব্যাটিং প্রতিভা ছিলেন এই ডানহাতি মধ্যম ডাব্লিউ। দারুণ স্ট্রোক প্লেয়ার ছিলেন স্যার উইকস। উইকেটের দুদিকেই দারুণ সব শট খেলতে পারতেন। চোখ আর হাতের দারুণ ব্যবহার করতেন শট খেলার সময় যেটাকে আমরা হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন বলি, এর সাথে ছিল মারাত্মক ফুটওয়ার্ক। এই কারণের জন্য স্যার উইকসের খেলা সবসময় দর্শকদের আনন্দ দিত কারণ তিনি কখনোই থেমে থাকতেন না, সবসময় স্কোরবোর্ডকে সচল রাখতেন। এছাড়াও দুর্দান্ত ফিল্ডিং করতেন, ফার্স্ট স্লিপে দাঁড়িয়ে মোট ৪৯টি ক্যাচ নিয়েছেন সারা জীবনে।
ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের বিখ্যাত “থ্রি ডাব্লিউ” ভেঙে যায় স্যার এভার্টন উইকসের অবসরের কারণে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সিরিজে তিনি উরুতে খুব বাজেরকম একটা চোট পান। যার পর বাকি দুই ডাব্লিউ খেলা চালিয়ে গেলেও তিনি আর কোনদিন ব্যাট হাতে মাঠে নামতে পারেননি। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে সেরা ব্যাটসম্যান বাছাই করতে গেলে জর্জ হ্যাডলির পরেই তাঁকে রাখতে হবে। কারণ মাত্র দশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি খ্যাতির চরম সীমায় আরোহন করেন শুধুমাত্র চোখ ধাঁধানো ব্যাটিং দিয়ে। আর গতকাল পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেল বিখ্যাত “থ্রি ডাব্লিউ”এর অস্তিত্ব। স্যার ওরেল আর ওয়ালকট আগেই চলে গিয়েছিলেন, কাল ৯৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন স্যার উইকস। আপনি বন্ধুদের পাশে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকুন স্যার। যতদিন ক্রিকেট খেলাটা পৃথিবীতে থাকবে ততদিন “থ্রি ডাব্লিউ” এর নাম সোনার অক্ষরে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। কারণ আপনাদের ক্রিকেট নিছকই ক্রিকেট ছিল না, ছিল ক্রিকেটের হাত ধরে কালো মানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। আপনারা পেরেছেন স্যার।